× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

আর্সেনিকে ভয়াবহ রুপ নিয়েছে তালার কৃষ্ণকাটি গ্রাম

তালা (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি

১০ অক্টোবর ২০২২, ০৪:২৩ এএম

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার কৃষ্ণকাটি গ্রামটিতে পানি বাহিত আর্সেনিক রোগের ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত বিশ বছরে এই গ্রামে আর্সেনিক নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের সাত জন সহ ৫০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানা গিয়েছে। 

আর্সেনিকের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে তালার কৃষ্ণকাটি গ্রামের প্রায় ২ হাজার মানুষ মানবতার জীবনযাপন করলেও নজরে আসেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। এমনকি বছরের কত জন মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার কোন সঠিক তথ্য দিতে পারেনি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের কর্তাদের কাছে। যদিও প্রশাসনের দাবি, আর্সেনিক প্রবণ এলাকায় তারা সুপেয় পানির ব্যবস্থা করছেন এবং অকেজো ওয়াটার প্লান্ট গুলো চালু করার ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে।

সরেজমিনে কৃষ্ণকাটি গিয়ে দেখা যায়, আর্সেনিক নামক নীরব এই ঘাতকটি এই অঞ্চলের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সাধারন মানুষের গ্রাস করেছে ফেলেছেন ইতিমধ্য। কৃষ্ণকাটি গ্রামের ২ হাজার লোক সংখ্যার সকল পরিবারের মধ্য  কেই না কেই এই মরণ ব্যাধি আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু তাদের রক্ষার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করছেন না কতৃপক্ষ ।

 জানা গেছে, দীর্ঘ ২০ ধরে বছর কৃষ্ণকাটি গ্রামের মানুষরা আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মানবতার সাথে দিনাতিপাত করছেন। শরীরে আর্সেনিকের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছে এখানকার মানুষ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুটিগুটি ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় রোদে গিয়ে পরিশ্রম করতে পারেন না এলাকার পুরুষেরা।

আর্সেনিক নিরোধকল্পে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে সুপেয় পানির প্ল্যান্ট করা হলেও সেগুলো দীর্ঘ বছর যাবত অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে উক্ত গ্রামের প্রতিনিয়ত আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছেন। এলাকার শিশুরাও আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছেন অনেকটা। এই এলাকায় নামকাস্থ গভীর নলকূপ থাকলেও আর্সেনিকমুক্ত পানি পাওয়া বেশ দুষ্কর। তাই এক প্রকার নিরুপায় হয়ে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছেন তারা। 

এদিকে, জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সরকারিভাবে ওয়াটার প্লান্ট বসানো হলেও সেটা দীর্ঘদিন যাবত অকেজো হয়ে পড়ে থাকার কারণে সুপ্রিয় পানি হতে বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাদের। নিয়ম অনুযাী প্রতি বছর দুই বার টিউবওয়েলের আর্সেনিক পরীক্ষা করার কথা থাকলেও জনস্বাস্থ্য বিভাগ তা করে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

তথ্যমতে, আর্সেনিক আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বা হাতের তালুতে বাদামি ছাপ পড়া সহ সাধারণত বুকে, পিঠে কিংবা বাহুতে ‘পিগমেনটেশন’ দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নেয়। সাদা এবং কালো দাগের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তির জিহ্বা, মাড়ি, ঠোঁট ইত্যাদিতে মিউকাস ব্রন মেলানোসিসও দেখা দেয়। কারও কারও হাতের চামড়া পুরো হয়ে যায়, আঙুল বেঁকে যায় । এছাড়া পায়ের আঙুলের মাথায়ও পচন ধরে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার অন্যান্য লক্ষণগুলো হচ্ছে- হজমে শক্তি কমে যাওয়া, পেটব্যথা, খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া ইত্যাদি। 

স্থানীয় বাসিন্দা রুমানা বেগম জানান, সর্বপ্রথম কৃষ্ণকাটি গ্রামে তার পরিবারে আর্সেনিক শনাক্ত হয়। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের সাতজন সদস্য মারা গেছেন। একই পরিবার থেকে এতগুলো মানুষ আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি। এলাকায় সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত তারা পানি নামক বিষ গ্রহণ করছেন। যার ফলশ্রুতিতে প্রতি বছরই এই গ্রামের অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। কখন নিজে ও সন্তানরা আর্সেনিকে আক্রান্ত হবেন, সেই শঙ্কায় রয়েছেন। 

স্থানীয় বাসিন্দা জলিল মোড়ল জানান, তার সমস্ত শরীরে আর্সেনিক আছে। তবে কোনো ওষুধ খেয়ে এটা থেকে মুক্তি মেলেনি কারও। তার বাবা-দাদারাও আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। টিউবওয়েলে আর্সেনিক পরীক্ষা করে লাল রং দিয়ে সনাক্ত করে গেলেও সরকার সুপেয় পানির ব্যবস্থা না করায় বাধ্য হয়ে সেই পানি গ্রহণ করতে হচ্ছে। 

রুহুল আমীন নামে অপর ব্যক্তি জানান, বর্তমানে কৃষ্ণকাটি এই গ্রামে ৫০-৬০টি পরিবারে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী রয়েছে। তিনি নিজেও একজন আর্সেনিক রোগী। রোদে গিয়ে পরিশ্রম করতে পারেন না, কারণ শরীরের ভেতর জ্বালাপোড়া করে। 

নাজমা বেগম নামে এক রোগী জানান, আর্সেনিকে তার স্বামী, ছেলে, দেবর ও শ্বশুর মারা গেছে। দীর্ঘ ২০-২২ বছর নিজেও আর্সেনিক বয়ে বেড়াচ্ছেন। ঢাকায় গিয়ে কেমোথেরাপি দিতে হয়। তবে টাকার অভাবে বহুদিন ঢাকায় যাওয়া হয়নি ও চিকিৎসাও করানো হয়নি তার। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এটা রোধে কোনো ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে কিছু বছর পরে হয়তো এই গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়বে।

জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল হক লিঠু জানান,  এই কৃষ্ণকাটি গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটা গওামে আর্সেনিকের ভয়াবহ আকার ধারণ করাসহ দিনদিন এরা মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই এলাকায় একই পরিবারের সাতজন ও  চারজন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আর্সেনিক প্রতিকার করার মতো কোনো চিকিৎসা নেই। তাই বাধ্য হয়ে তারা এই ব্যাধি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। সাধারণত বিশুদ্ধ পানির অভাবে আর্সেনিকের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে নানান ধরনের ক্ষত সৃষ্টির একটি পর্যায়ে ক্যান্সারে রূপ নিয়ে। আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়।

তিনি আরও জানান, ইতোপূর্বে অনেকবার কয়েকটি ওয়াটার প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়েছে। তবে সেটাতে আর্সেনিক নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। যদি আর্সেনিকমুক্ত ওয়াটার প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে আর্সেনিকের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পারেন বলে জানান তিনি।

তালা উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপ-প্রকৌশলী মফিজুর রহমান জানান, আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকা সহ আশাপাশের এলাকাগুলোতে  অতিদ্রুত পুনরায় আর্সেনিক পরীক্ষা করা হবে। ওই এলাকায় কয়েকটি ওয়াটার প্ল্যান্ট করা থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এ বিষয়টি নিয়ে দ্রুত কাজ করা হবে। ওয়াটার প্ল্যান্টগুলো চালু করে তাদের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো.হুসাইন সাফায়াত জানান, আর্সেনিক আক্রান্তদের খুব বেশি ভালো কোনো চিকিৎসা নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু মেডিসিন তাদের জন্য সাজেস্ট করা হয়। এতে করে আর্সেনিকের প্রবলতা কিছুটা কমে গেলেও সেটি নির্মূল হয় না।আর্সেনিকে আক্রান্ত ব্যক্তির সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু।এ জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হল প্রথম থেকে আর্সেনিকযুক্ত পানি না খাওয়া, বিশুদ্ধ পানি পান করা। প্রথমদিকে এটা নিয়ে বেশ জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা হয়েছে এবং বিনামূল্যে পানির আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে।তাছাড়া যে পানিটা আমরা পান করি, সেটা বছরে দুই বার শীতের সময় ও বৃষ্টির সময় আর্সেনিক পরীক্ষা করতে হবে। 




Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.