× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

কবিয়াল বিজয় সরকারের গান: বৈভবে অনুভবে

অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন আরা সাথী

০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:৩৩ এএম

কবিয়াল বিজয় সরকার বাংলার অহংকারের নাম। কবিতার মতো করে শব্দের বুননে তিনি গান রচনা করেছেন। উতোর চাপান কেন্দ্রিক লোক গানের এই ধারাটির নাম কবিগান, আর এই গানের গায়ককে বলা হয় কবিয়াল। ইতিহাসে কবি গানের স্বর্ণযুগ ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মরমী গানের স্রষ্টা বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে। র্অথাৎ কবি গানের স্বর্ণযুগের অর্ধশতাব্দীকাল পরে এই সাধকের জন্ম। নগর সংস্কৃতি যখন কবি গানকে গ্রাস করতে বসেছে তখন তিনি দেহাত্ম চেতনা ও অধ্যাত্মবাদের রস সিঞ্চনে কবি গানে প্রাণ এনেছেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বিভাগোত্তর পূর্ববাংলায় কবিগানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

বিজয় সরকারের ১৭টি কবিগান পাওয়া যায়। কবিগানকে নিয়ে ভাবতেন এই গানে তিনি তাঁর সৃজনীশক্তি ও জীবনদর্শনের সমন্বয়ে নতুনত্ব দান করেছিলেন। এই নতনত্ব ভাবনার গানগুলোই তাঁর ‘কবি নিরপেক্ষ’ গান নামে পরিচিত। তাঁর একটি বড় গুণ ছিল তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে তিনি গান লিখলেও সেসব গানের লেখ্যরূপ দিয়েছেন। নিজস্ব ঢঙে বিচ্ছেদী গান রচনা করেছেন যা ‘বিজয়বিচ্ছেদ’ নামে পরিচিত। এছাড়াও কবিগানে পরিশীলিত শব্দ অলংকার যোজনা করে একে আরো হৃদয়গ্রাহ্য করেছেন। তাঁর বিখ্যাত একটি গান হচ্ছে “জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি/ আমরা বহু নামে ধরাধামে কত রকমে ডাকি/ কেউ তোমায় বলে ভগবান আর গড কেউ করে আহ্বান/ কেউ খোদা কেউ জিহুদা কেউ কয় পাপীয়ান/ গাইলাম জনম ভরে মুখস্থ গান মুখ বুলা টিয়াপাখী/ সর্বশাস্ত্রে শুনিতে যে পাই তোমার নাকি পিতামাতা নাই/ তবে তোমার নামকরণ কে করলে সাঁই বসে ভাবি তাই/ তুমি নামি কি অনামি হে সাঁই আমরা তার বুঝি বা কি/ কেহ পিতা কেহ পুত্র কয় আবার বন্ধু বলে কেউ দেয় পরিচয়/ তুমি সকলেরই সকল আবার কারো কেহ নয়...”

এরকম বহু অজানা প্রশ্ন মানুষকে আজও সমভাবে ভাবিত করে। বিজয় সরকারের সৃষ্টির অভিনবত্বে এবং বিষয় ভাবনার নতুনত্বে তিনি আধুনিক। তাঁর কবিত্ব শক্তি, শাস্ত্রজ্ঞান, সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ দখল তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।

বিজয় সরকার গানের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথার সমালোচনা করেছেন। তিনি নিজে ছিলেন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ে তথা নিম্নবর্ণের। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়ায় অনেক অবহেলা, ঘৃণা আর বঞ্চনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে বিজয় সরকারকে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন। সমাজে শ্রেণি বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। একবার বাগেরহাটের এক গ্রামে গান গাইতে গেলে এক পণ্ডিতের বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পণ্ডিতমশাই কাঁসার গ্লাসে না দিয়ে পিতলের গ্লাসে জল দেয়ার কথা বলেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, কাঁসা মিশ্র ধাতু, আর পিতল মৌলিক ধাতু। মৌলিক ধাতুতে জীবাণু ঢুকলে মাজলে চলে যায়। কিন্তু মিশ্র ধাতুর জীবাণু দূর করতে হলে সেটা পোড়াতে হয়। বুদ্ধিমান বিজয়ের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আসল রোগ হচ্ছে বর্ণপ্রথা। তিনি প্রতিবাদ করে না খেয়েই উঠে যান। পরে পণ্ডিতমশাই ভুল স্বীকার করলে তবে ফেরেন। বিজয় তখন গেয়ে ওঠেন ‘আবাল্য কুসংস্কার যার জীবন সাহিত্যে/ কৌণবৃত্তি ঘোচে না তার সহস্র পাণ্ডিত্যে।’

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে গান বাঁধেন “জাতি বলতে কী বুঝলেন পণ্ডিতমশাই,/দেখি জগতে এক মানব দুই ভাগে বিভক্ত তাই।/ ব্রাহ্মণ ক্ষৈত্র বৈশ্য শূদ্র্র, কেহ বৃহৎ কেহ ক্ষুদ্র/ আচরণে ইতর ভদ্র গুণ কর্ম অনুযায়ী,/ কেহ ওঠে বহু উচ্চে, কেহ পড়ে অনেক নিচে,/ গুণের মাত্র জাতি আছে, গুণীর কোনো জাতি নাই।”

অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি এক বালিকা বিধবাকে নিজের এক ভক্তের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষ কর্তৃক ধিকৃত হয়েছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন, ‘সামাজিক অনাচার, জাতিভেদের বিরুদ্ধে আমি সাম্যের গান গাই।’ ধর্মীয় বিভেদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ধর্মে ধর্মে এতো বিভেদ আসলে মানুষেরই তৈরি। আসল জিনিস রেখে নকল নিয়ে মানুষ বেশি মাতামাতি করে বলেই এ অবস্থা’।

জাতি নিয়ে বিজয় সরকারের ভাবনা ছিল স্বতন্ত্র। জাতিভেদ বলতে তিনি কেবল দুই জাতিকে বুঝেছেন, নারী ও পুরুষ জাতি। তিনি এক লেখায় বলেনÑ “কেহ হিন্দু কেহ মুসলমান কেহ বৌদ্ধ কেহ খ্রীষ্টান/ সৃষ্টির পানে দৃষ্টি দিয়ে স্রষ্টার প্রতিষ্ঠান/ ইহার মূলে নাই কিছু ব্যবধান, খুলে দেখ জ্ঞান নয়ন।”

দেশের প্রতি বিজয় সরকারের গভীর অনুরাগ ছিল। দেশ বন্দনার গানে তাঁর অকৃত্রিম আবেগ ফুটে উঠেছে “তুমি যে দেশে বাস করো রে বন্ধু, সে দেশ যেন কতই সুন্দর।/ তোমার নন্দনকানন আনন্দধাম, দেখে হার মানে স্বর্গের পুরন্দর.../ তোমার দেশের আকাশ আলো, জল বায়ু স্থল সবই ভালো,/ যেভালো তার সবই ভালো, ভালো নাই সে ভালোর পর,/ পাগল বিজয় কয় আকুল পিয়াসে তোমার বাড়ির পাশে বাঁধি ঘর।”

বিজয় সরকার ব্যক্তিগত জীবনে দেখেছেন দেশভাগ, দেশভাগোত্তর জাতীয় জীবনে মূল্যবোধের অবনতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসহীনতা, ছিন্নমূল মানুষের অসন্তোষ, জনজীবনে আতঙ্ক ও দূর্যোগের কালোছায়া। তিনি দেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। বাংলাদেশের সংকটময় মুহূর্ত নিয়ে তিনি লিখেছেন “বাংলাদেশের কি দুর্দশা উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা,/ কেনো আশা ভরসা দেখিনে;/ মলিন হলে মাতৃভাষা, জীবনবৃদ্ধিও নাহি আশা,/ ব্যর্ত হয় আত্মউন্নয়নে।”

সাতচল্লিশের দেশভাগ আমাদের আরেকবার পরাধীনতার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করেছিল। পাকিস্তানি শাসকদের চব্বিশ বছরের নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি গর্জে ওঠে। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নিল ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। স্বাধীনতা আন্দোলনকে কবিয়াল বিজয় সরকার সম্মান জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন “স্বাধীনতা আনতে কেড়ে চলেছে ঐ মুক্তি সেনাদল/ তাদের পায়ের ভারে কাঁপছে ধরা সৃষ্টি করে টলমল।/ কিছুতেই আর মানবো না হার জয় বাংলার লেগেছে জোয়ার/ মুক্ত করবে স্বদেশ আমার হানাদার যাবে সব রসাতলে।”

প্রগতিভাবনার অধিকারী কবিয়াল বিজয় সরকার মানুষের একাত্মতায় বিশ্বাসী ছিলেন  সবার উপরে মানুষ সত্য এই চিরন্তণ বাণী তাঁর জীবন আবিষ্ট করেছিল। ফলে তিনি মানতেন এবং জানতেন মানুষের পথ ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য এক “জল পাণী ওয়াটার ব’লে মানুষের ধারণ,/যে নামে সে জানে মানে পিপাসার কারণ,/.../আল্লা-হরি-খোদা কিংবা ভগবান,/ গড বলে কেউ, কেহ তারে বলে পাথিয়ান।/.../হিন্দু-মুসলমান জাতি ধর্ম দরদী’/ জৈন শিখ বৌদ্ধ খৃষ্টান,আরো জাতি ইহুদি,/ সবার আসা যাওয়া একই বিধি, বিধির বিধান দেখো।

বিজয় সরকার সমকালীন সমাজ নিয়ে ভেবেছেন। মুসলিম সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গান রচনা করেছেন। যেমন কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লিখেছেন “উজ্জ্বলিত কবিকূল, করিলে কবি নজরুল, ভুল ভাঙানো মন্ত্রেও আমন্ত্রণে।/ ঘুমন্ত আছিল যারা, জীবন্ত হইল ত্রা, তোমার উদাত্ত কন্ঠের আহ্বানে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখেছেন “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কে বলে আজ নাই,/ এই মহাদেশ পূর্ণ পৃথিবীর, দেখি তারে যেদিক চাই।”

কবি জসীম উদ্দীন ‘স্মৃতির পট’ গ্রন্থে বিজয় সরকারের সঙ্গে তাঁর গভীর জানাশোনার কথা উল্লেখ করেছেন। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে বিজয় সরকার জসীমউদ্দীনের সাথে গান করেছেন। কবি জসীদ্দীন স্মরণে বিজয় সরকার লিখেছেন “নক্সী কাঁথার মাঠেরে-/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রুপাই মিয়ার বাঁশের বাঁশি।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে কবিয়াল বিজয় সরকার একাধিক গান লিখেছেন। যেমন “মহিমায় যার মুখরিত রাষ্ট্রপুঞ্জ অবধি,/ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দীন দরিদ্রের দরদী,/ সে যে স্বাধীনচেতা নেতা, নহে অদৃষ্টবাদী।”

বিজয়  সরকার কৃষ্ণ প্রেমে পাগল এক কবি। তবে তাঁর প্রেম ভাবনায় নতুনত্ব আছে। বিজয়ের গান শুনে মনে হতে পারে তিনি বাঁশি বন্দনায় মেতেছেন। অর্থাৎ প্রেম ভাবনায় তিনি ছিলেন আধুনিক “তুমি জানো না রে বাঁশি/ গোপনে গোপনে তোমায় কতো ভালোবাসি,/ লোকের চোখের আড়াল থেকে/ দেখি তোমার মুখের হাসি।”

তাঁর বিখ্যাত গান “এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে...”- যা মানুষকে এখনো নবপ্রণে উজ্জীবিত করে। কবিগানের সম্রাট বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী কারো কাছে তিনি ‘চারণ কবি সম্রাট’, কারো কাছে ‘ভাটিয়ালী গানের রাজা’, আবার কারো কাছে ‘শ্রেষ্ঠ কবিয়াল’। তবে, গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘পাগল বিজয়’ বলেই সমধিক পরিচিত। যে যেভাবেই কবিয়াল বিজয়কে দেখুক না কেন, তিনি আমাদের লোকসঙ্গীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এখনো তিনি অতিপ্রিয়, একান্ত আপনজন। অন্ত্যজ মানুষের জয়গান গাওয়া এক অনন্য আধুনিক শিল্পী ও কবিয়াল বিজয় সরকারের ৩৭তম মহাপ্রয়াণবার্ষিকী। ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেলুড়িয়া নামক স্থানে কন্যা বুলবুলির বাড়ি বিধান পল্লীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।


লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.