কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী মান্না দে’-এর সাথে সাংবাদিক হিসেবে জীবনে দুইবারই আমার তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয়েছিলো একবার কোলকাতায় আর একবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। সেই স্মৃতি থেকেই এই লেখা। গত সোমবার ছিলো তার প্রয়াণ দিবস। সময় কতো দ্রুত চলে যায়! মনে হয় এইতো সেদিন গুনী এই কিংবদন্তীর সাথে কথা বললাম! আহা স্মৃতি! মনে পড়ে প্রথম মান্না দে ঢাকা এসেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক চুক্তি বিনিময়ের অংশ নিতে ১৯৯৬ সালে। এরপরে সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০০৯ সালে।
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই…” প্রবোধ চন্দ্র দে, আমাদের কাছে পরিচিত ‘মান্না দে’, তার গায়কিতে মুগ্ধ হয়ে না জানি কত মানুষ কখনো না কখনো হারিয়েছে এই কফি হাউজের গানটিতে, বারবার মনে করেছে হারিয়ে যাওয়া কোনো আড্ডা বা আড্ডাবাজ বন্ধুদের। কফি হাউজের আড্ডাটির মতো, মান্না দে’ও হারিয়ে গেছেন, তিনিও আজ আর নেই সুন্দর ভুবনে।
যতদিন ছিলেন, ততদিনই যেন সুরমূর্ছনায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন একাধারে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটিসহ অজস্র ভাষার সঙ্গীতপ্রেমীদের। তবে বাংলা গানে তার যত ভক্ত, তত বোধহয় আর কোনো ভাষায় নেই। ওপার বাংলার আরেক বিখ্যাত শিল্পী নচিকেতা তো তার গানে বলেই দিয়েছেন ভক্তদের মনের কথা, “আর বিরহের কথা এলে, বুকের জ্বালা ভুলে, আজো মাঝে মাঝে গাই মান্না দে’র গান”। ঠিক তাই! মান্না দে’র গান মানেই প্রেম, তা সে সফল কিংবা ব্যর্থ যাই হোক না কেন। কোনো ব্যর্থ প্রেমিক যেমন গেয়ে উঠতে পারেন, “ও কেন এতো সুন্দরী হলো?”, তেমনি বিচ্ছেদও ব্যক্ত করা যায় এভাবে, “এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি, মাঝখানে নদী সব বয়ে চলে যায়…”। তাই আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে মান্না দে’র গান এক বিশেষ আবেদনের জায়গায় অবস্থান করে। গানে যার প্রেম বইত, তার জীবনেও প্রেমের স্থান ছিলো বিশেষ প্রথম দেখাতেই নাকি মান্না দে প্রেমে পড়েন সুলোচনা কুমারনের, অতঃপর বিয়ে, দাম্পত্যজীবনে তারা দু’টি কন্যাসন্তান জন্ম দেন- সুরমা ও সুমিতা। ২০০৯ তার সাথে সাক্ষাৎকারে মান্না দে বলেছিলেন ,“আমার জীবনের সক্কলের চাইতে বড় পাওয়া আমার স্ত্রী। ওকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে যা বোঝায়, তাই হয়েছিলো আমার। এরপর আমরা একে অপরকে জানলাম, বিয়ে করলাম। এই ৫৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সবসময়ই ওকে আমার সঙ্গী হিসেবে যেমন সেরা মনে হয়েছে, তেমনি বন্ধু হিসেবেও সেরা, যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করার জন্য সেরা।
ও শুধু আমার স্ত্রীই নয়; আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমার সবচেয়ে বড় সমালোচকও”। ২০১২ সালে সুলোচনা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এবং এরপর এক স্মৃতিচারণে মান্না দে বলেন যে, তার শেষ ইচ্ছা হচ্ছে তার মৃতা স্ত্রীর জন্য একটি প্রেমের গান রেকর্ড করা এবং তিনি সেটি করেও গিয়েছেন। নিয়ম মেনে চলতেন সবসময়ই তিনি, নিজের চারপাশে নিয়মের দেয়াল করে রেখেছিলেন, তার মতে তার এই নিয়ম মেনে চলাই তার চিরসবুজতার রহস্য। যৌবনে শারীরিক কসরৎ করতেন, খেলাধুলায়ও ছিলেন পটু, তার এই নিয়মের অনেকটাই সেখান থেকে পাওয়া। ছোটবেলায় বাবা পূর্ণ চন্দ্র দে শিখিয়েছিলেন, সবকিছু সময়মতো করতে হবে, সে কথাই মনে রেখে জীবনযাপন করেছেন মান্না দে। তাই তো ৯০ বছর বয়সেও গান করতে পেরেছেন, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে পেরেছেন। প্রতিদিন পাক্কা দু’ঘণ্টা রেওয়াজ করেছেন দীর্ঘ ৬০ বছর, তার মতে সঙ্গীতে তার শিক্ষাজীবন কখনো শেষই হয়নি। সব গায়ক, সব সুর থেকে শিখেছেন তিনি, কখনো ভাবেননি তার শিক্ষা শেষ হয়ে গেছে! নিজেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আরেকটু সমৃদ্ধ করতে ভালবাসতেন, চাইতেন তার গায়কিকে আরো মোহনীয় করে তুলতে। গানই ছিলো তার জীবন। সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন মান্না দে তার জীবনে সঙ্গীতের হাতেখড়ি করান যিনি মান্না দে সবসময়ই তার গানের প্রথম গুরু মেনেছেন তার কাকাকে।
তার মতে, কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে তাকে কখনো দু’টো মেডেল আর একটা কাপ পাওয়ার জন্য গান শেখাতেন না। সঙ্গীতের প্রথম পাঠ নিজে নিজেই নিয়েছিলেন মান্না দে, একে শ্রুতিশিক্ষাও বলা চলে। কাকার সুবাদে ভারতের বিখ্যাত গাইয়েরা ভিড় করতেন বাড়িতে, তাই গানের সা-রে-গা-মা নিজে নিজেই শেখেন তিনি। কাকা কৃষ্ণচন্দ্রের ছাত্র হয়েছিলেন সেই একেবারে গ্র্যাজুয়েট হবার পর। পড়াশুনা শেষে গায়ক হওয়াই যেন স্থির করলেন তিনি, আদর্শ হিসেবে হয়তো সেই কাকাকেই দেখতে পেয়েছিলেন! ধাপে ধাপে এগোন তিনি, কাকার কাছে শেখার পর কাকার ওস্তাদ দবীর খাঁ’র ছাত্রত্ব গ্রহণ করলেন। এরপর ১৯৪২ সালে বোম্বে গিয়ে ফিল্মের গান গাওয়াতে যোগ দিলেন। প্রথম দিকে শচীন দেব বর্মণ এর অধীনে কাজ করেন মান্না দে। এছাড়াও বহু স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’ ছবিতে মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হওয়া কিংবদন্তী এই শিল্পীর জন্ম ১ মে ১৯১৯। এবং মৃত্যুবরণ করেন ২৪ অক্টোবর, ২০১৩। গত সোমবার ছিলো তার প্রয়াণ দিবস।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh