× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল!

চিররঞ্জন সরকার

০৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৪৯ এএম

আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের স্বভাবই হচ্ছে সমালোচনা করা, খুঁত ধরা। তারা সবকিছুতে সন্দেহ-সংশয় ব্যক্ত করে। একদম নির্দোষ জিনিসের মধ্যেও খুঁত বের করে। নিন্দা করে। এ প্রসঙ্গে বহুল প্রচলিত একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। এক ধনী লোক এবং এক গরিব লোকের ছেলে এক সঙ্গে লেখাপড়া করত। কিন্তু‘ ধনীর ছেলেটি ঠিকমতো লেখাপড়া করত না, তাই পরীক্ষার পর দেখা গেল ধনীর ছেলে ফেল করেছে আর গরিবের ছেলে পাশ করেছে। এতে ধনী লোকটির মানসম্মান থাকে না। আরেক জন এই সুযোগে ধনী ব্যক্তিটিকে একটু খোঁচানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। সে গরিব ব্যক্তির ছেলেটির পাশ করার খবরটি উল্লেখ করে বলে, শুনলাম অমুকের পোলায় বিরাট পাশ দিছে। ধনী ব্যক্তিটি জবাব দেয়, পাশ কইরা লাভ কী? চাকরি তো পাইব না। কিন্তু দেখা গেল ছেলেটি ভালো একটা চাকরি পেল। এখন আবার ঐ খোঁচানো স্বভাবের ব্যক্তিটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ধনী লোকটি বলে, চাকরি পেলে লাভ হবে কী? বেতন তো পাইব না। কিন্তু দেখা গেল মাস শেষে ভালো বেতন পেল! এবার ঐ ধনী ব্যক্তিটির মুখ থেকে শোনা গেল: বেতন পাইলে কী হবে? ঐ টাকা কোনো কাজে লাগবে না! সুখ পাইব না!

উল্লিখিত গল্পটিতে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এই শ্রেণির মানুষেরা ভীষণ রকম সংশয়বাদী এবং তারা সবকিছুতেই একটা ‘কিন্তু খোঁজে। সবকিছুর মধ্যে নেতিবাচক কিছু খুঁজে বের করাই তাদের স্বভাব। তারা আসলে নিন্দুক।

যদিও কবি বলেছেন, ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল,/যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আঁলো।/সবাই মোরে ছাড়তে পারে, বন্ধু যারা আছে,/নিন্দুক সে ছায়ার মত থাকবে পাছে পাছে।’

বাস্তবে নিন্দুককে ভালোবাসা সহজ নয়। কারণ এই নিন্দুকরা আমাদের জীবনের পথে অকারণ সমালোচনা আর উপহাসের বাণী বর্ষণ করে মনকে বিষিয়ে তোলে। একথা ঠিক যে কাজ করলে ভুল হবেই। আর মানুষ মাত্রেই ভুল করে। সেই ভুলের সুযোগ নেয় নিন্দুক। মানুষের ছোটখাটো দোষ-ত্রুটিকে বড় করে দেখিয়ে কুৎসা রটনা করে বেড়ানোই নিন্দুকের কাজ। ফলে আমরা নিন্দুকের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। কারণ সবার পক্ষে মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে নিন্দা-সমালোচনাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না।

পৃথিবীর সব দেশেই এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যারা অকারণে অন্যের নামে সমালোচনা করে। এই নিন্দুক ব্যক্তিদের সমালোচনার শিকার হয়ে অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাদের মনের ভেতর জন্ম নেয় অজানা এক ধরনের ভয় ও লজ্জা। স্যার উইনস্টন চার্চিল সমালোচনার কষ্টকে ‘শারীরিক ব্যথার চেয়েও বেশি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিš‘ মানুষ তারপরও কেন অন্যের সমালোচনা করতে এত পছন্দ করেন তা এক রহস্য।
সমালোচনার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। সমালোচনা যেমন মানুষের ভুল শুধরে দেয় আবার অনেক সময় তা এমন পর্যায়ে চলে যায়, যা মানুষের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। আমাদের প্রত্যেককেই সমাজে চলতে-ফিরতে নানা রকম সমালোচনা শুনতে বা করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, সমালোচনা ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। সমালোচনার ভাষা এমন থাকে, যা মোটেও যৌক্তিক নয়। আবার অনেক সময় কেউ কেউ শুধু কাউকে অপছন্দ করে বলে সে যা-ই করুক যা-ই লিখুক, যা-ই বলুক, সেটা নিয়ে সমালোচনা করে থাকে। ভালো-মন্দ কোনো কিছুই বিবেচনা করে না।

ব্যক্তিকে নিয়ে আমরা যেমন সমালোচনা করি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকার, রাজনৈতিক দল নিয়েও আমরা প্রতিনিয়ত সমালোচনা করি। এই সমালোচনা অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্বেষমূলক হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত লাভ, স্বার্থ, পছন্দ-অপছন্দকে কেন্দ্র করে সমালোচনা বা নিন্দা আবর্তিত হয়।

আমেরিকান লেখক, দার্শনিক এলবার্ট হাবার্ডের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে : সমালোচনা এড়াতে চাইলে কিছু কোরো না, বোলো না, হইয়ো না। যার জীবনে কোনো অর্জন নেই, যে পৃথিবী ধ্বংস হলো কী গড়ল এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করার তেমন কিছু খুঁজে পায় না। যখনই আপনি কিছু করতে যাবেন, কিছু একটা বলতে যাবেন, কিছু একটা হতে যাবেন, পৃথিবী দুই ভাগ হয়ে যাবে। একদল আপনাকে প্রশংসা করবে, আপনি আরো এগিয়ে যান সেই কামনা করবে, আর আরেক দল আপনার মুণ্ডপাত করবে।

সমাজে অনেক মেধাবী ও গুণী মানুষ আছেন যারা শুধু উটকো সমালোচনার ভয়ে নিজের নিরাপদ বলয়ের বাইরে বের হন না। ‘কী দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে, ভালোই তো আছি’- এটা হচ্ছে তাদের চিন্তা। তাদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমালোচনার বারুদও অনেক তাড়াতাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপনি হয়তো কোনো গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্কুল করে দিলেন। দুটি পত্রিকায় আপনাকে নিয়ে বিশাল প্রশংসাসূচক লেখা ছাপা হতে না হতেই অন্য তিনটা পত্রিকায় আপনার নামে যাবতীয় কুৎসা ছড়ানো হবে। পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, করপোরেট শক্তির ইন্ধনে আপনি যে স্কুলের নাম করে তলে তলে ‘বিশাল ষড়যন্ত্র’ করে বসে আছেন সেটা নিয়ে অনেক কেচ্ছা-কাহিনী ছাপানো হবে। অথচ আপনি শুধু ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন, এই যা।

আমাদের দেশে এটা প্রচলিত আছে যে, এখানে একজন মানুষের ক্ষতি করা অনেক সহজ কিন্তু কারো উপকার করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। আমরা বাংলাদেশের মানুষরা চারদিকের নেতিবাচক জিনিসে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এখন আর মানুষের ‘ভালোত্বে’ বিশ্বাস করি না সহজে। কেউ যে বিনা কারণে ভালো হতে পারে, স্বার্থহীন হতে পারে এটা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হয়। আমরা কেন উন্নত হতে পারছি না? আমাদের কেন মনে হয় চারদিকের সবাই খারাপ, সবাই ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী? যেসব মানুষের নিজের ওপর শ্রদ্ধা কম তারা বেশি সংশয় ও কুসংস্কারে ভোগে। সমালোচনায় মুখর হয়। অর্থাৎ যেসব মানুষ আসলে নিজের যোগ্যতা নিয়ে খুশি নয়, নিজের ওপর নিজের খুব বেশি শ্রদ্ধা নেই, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে, তারা সাধারণত মানুষকে নিয়ে বেশি নেতিবাচক কথা বলে। অন্যের ভালো কিছু দেখলে তারা সহজে খুশি হতে পারে না, তাদের প্রথম চিন্তাটি হয় নেতিবাচক।

যারা সমালোচনার ভয়ে বসে না থেকে নিজের মনের কথা বলে ফেলে, দেশের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করে, নিজে কিছু একটা হতে চেষ্টা করে তাদের নিয়ে প্রয়াত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একটা যুগান্তকারী কথা বলেছিলেন: ‘যারা সমালোচনা করছে তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যারা আঙুল উঁচু করে দেখিয়ে দিচ্ছে শক্ত মানুষটি কীভাবে হোঁচট খাচ্ছে তারাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। যারা বাইরে থেকে উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন কীভাবে কাজটা আরও ভালোভাবে করা যেত তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সব কৃতিত্ব হচ্ছে তার, যিনি আসলে সত্যিকার মাঠে নেমে যুদ্ধ করছেন। যার মুখ ও দেহ ধুলো, ঘামে ও রক্তে রঞ্জিত। যিনি জীবন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যিনি বারবার ভুল করছেন এবং জয়ের একেবারে শেষ মাথায় এসে পৌঁছাচ্ছেন। যিনি চরম উৎসাহ, আগ্রহ, সাধনা নিয়ে নিজেকে একটা অর্থপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেছেন। যিনি বিজয়ী হওয়ার কৃতিত্বের কথা জানেন কিংবা যদি জয়ী হতে নাও পারেন, অন্ততপক্ষে বীরের মতো চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অতএব, তার স্থান কখনোই সেসব ভীরু ও দুর্বল মানুষের সঙ্গে হবে না, যারা জয় কিংবা পরাজয় কোনোটার স্বাদ কখনো পায়নি।’

সমালোচনা আমরা অবশ্যই করব, কিন্তু শুধু শুধু সমালোচনা করে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে আমরা কারো সৎ ও আন্তরিক উদ্যোগে যেন বাগড়া না দিই! নিজে কিছু করতে না পারি, না-ই করলাম, কিন্তু যে কিছু একটা করছে, খামোখা কেন তার পথকে কণ্টকিত করব?

কিন্তু তারপরও নিন্দুকরা নিস্ক্রিয় হবে বলে মনে হয় না। তাদের ব্যপারে কর্মী ও উদ্যোগী মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে তাদের মুখে ঝামা ঘঁষে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে ডিএল রায়ের কবিতার সেই ‘নন্দলাল’ হয়ে ঘরে শুয়ে-বসেই সাধের জীবনটা পার করে দিতে হবে!



Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.