মূলত বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক, রাজনৈতিক ও কারাজীবন একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু বিয়ে করেছেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেছা রেণুর সঙ্গে কমতি ছিল না। তবে এই দুরন্তপনার মধ্যেও গ্রাম্য ছেলেটির উদার মনের পরিচয় তুলে ধরেছেন লেখক। ওই বয়সে টুঙ্গীপাড়ায় মুসলিম সেবা সমিতিতে যোগ দিয়ে গরিব ছেলেদের লেখাপড়ায় সহায়তা করেছেন তিনি। বিষয়টি আজকের দিনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এন্ট্রান্স পাস করে ত্যাজদীপ্ত মন নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যৌবনে কলকাতায় পড়তে যান। তিনি সংসারমুখী হননি। বরং দেশ ও মানুষের কাজে লিপ্ত থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।
এ সময় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অস্তমিত হবার সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে আছে গ্রেট ব্রিটেন। ভারত ছেড়ে চলে যাবে ব্রিটিশ। যাবার পূর্বে কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের কাছে ভারত ভাগ করে দেবে, যেন ব্রিটিশ চলে যাবার পরও তার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থাকে। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় অসহায় মানুষের কথা ভেবে রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন। কলকাতায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে তার প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে পারেননি তিনি। এ সময় কলকাতার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় মানুষের সহায়তায় কাজ করছেন শেখ মুজিব। রাজনীতির জীবনের শুরু থেকেই শেখ মুজিব নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থ দেখেছেন বার বার।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান শাসনামলের ২৪ বছরের মধ্যে প্রায় ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের জেল জীবনের দিনগুলোতে মূলত সংসার দেখভালের দায়িত্ব নেয় স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। সন্তানদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে বাসাভাড়া, বাসা পাল্টানো, নতুন বাসায় ওঠা, বাজার করা, অতিথি আপ্যায়ন করা এবং উকিল মুক্তারের কাছে দৌড়ানো সব কিছুই নিজ হাতে সামাল দিয়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণু। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকার কথা বেশ কয়েক জায়গায় বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। বিষয়টি অবশ্যই তাৎর্যপূর্ণ। কারণ সুসময়ে অনেক বন্ধু বটে অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়। যখনই শেখ মুজিবুর রহমান জেলে গিয়েছেন মমিনুল হক খোকা বঙ্গমাতার আদেশ মতো কাজ করেছেন। উকিল মুক্তারের সাথে যোগাযোগ করে, জেলে কীভাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করা যায়, সে ব্যবস্থা খোকাই করাতেন। এমন কি ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে হানাদার বাহিনী যখন বন্দি করে নিয়ে যায় তখনো খোকা ছায়ার মতো পরিবারকে অনুসরণ করেছেন। এই রাতে বঙ্গবন্ধু ফজিলাতুন্নেছাকে বলেন,আমি জানি না আমার ভাগ্যে কি হতে যাচ্ছে। খোকা রইল, ও তোমাদের দেখবে। খোকা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুবই স্নেহধন্য এবং কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি।
পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবুর রহমান দুইবার মন্ত্রী হয়েছিলেন প্রথমবার ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে। কিš‘ খুব বেশি দিন সরকারি বাড়িতে থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সাথে মিশে থাকা ফজিলাতুন্নেসা রেণু বুঝতে পেরেছিলেন শহরে একটি বাড়ি না থাকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। তাই ধার কর্জ করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি তিনি ক্রয় করেছিলেন। এতে শেখ মুজিবের ঢাকা শহরে থাকার ভাবনা অনেকটা কমিয়ে দেন তিনি। যে গুরুদায়িত্ব স্বামীর পালন করার কথা, সে দায়িত্ব পালন করছেন স্ত্রী। দাম্পত্য জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ ভালোবাসা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলার মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সংসার না করেও তিনি সংসারী। লালন সাঁইয়ের সেই গানের মতো, আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না, চুল ভিজাবো না, আমি বেণী ভিজাব না। জলে নামব জল ছড়াব জল তো ছোব না... । বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন বাংলার দুঃখী মানুষকে ভালোবেসেছেন, এ বাংলার উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। তাঁর সংসার ছিল পূর্ববাংলার মানুষকে নিয়ে। পূর্ব বাংলার মানুষ দু’বেলা যেন খেতে পায়, পরনে যেন কাপড় পায়, তাই নিয়েই ছিল সার্বক্ষণিক চিন্তা। আপন সংসারের ক্ষুদ্র গন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমান কখনো ডুব দেননি।
বঙ্গবন্ধুর দুটি বিশেষ চিঠি যা তিনি একটি স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছাকে লেখা এবং অপরটি বড় কন্যা শেখ হাসিনাকে লেখা। আবেগঘন চিঠিতে তিনি সন্তানদের খোঁজ খবর জানতে চেয়েছেন। সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ঈদে সন্তানরা নতুন পোশাক না কেনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জেল থেকে তিনি কামালের স্বা¯’্য খারাপ হয়ে যা”েছ তা অনুভব করেছেন। শেখ হাসিনার কাছে লেখা পত্রে সুদুর সুইডেনে অব¯’ানরত জামাইয়ের খবর নিয়েছেন ইত্যাদি বিষয়সমূহ খুবই মর্মস্পর্শী। পারিবারিক জীবনের সাথে রাজনৈতিক জীবনের অনেক ঘটনা জড়িত আছে সেই দুটি বিশেষ চিঠিতে।
বাংলার মানুষ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তার একটি সুন্দর চিত্র দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর কথায়। তিনি দেশভাগের পূর্বের একটি বিশেষ রাজনৈতিক সভার কথা বলতে গিয়ে বলেন, টুঙ্গীপাড়ায় এক সভায় হঠাৎ এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ওঠে বলেন, হক সাহেব যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব। কাজ করলে মানুষ মনে রাখেন-অন্যথায় কেহ মনে রাখে না। গ্রাম্য এই লোকটির উদ্ধৃতিতে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান। নেতা ও নেতৃত্বের গুরুত্ব বুঝতে শেখ মুজিবুর রহমানের জুড়ি নেই- এ কথাটি বার বার মনে পড়ে।
এতবড় রাজনীতিবিদ হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন আট দশটা পিতার মতো। কন্যা বড় হলে তাকে পাত্রস্থ করতে হনে এ চিন্তা তারও ছিলো। কিন্তু তিনি তো জেলে, কখন কি হয় তিনি তা জানেন না। যদি বড় কিছু হয় সন্তাদের দুঃখ-কষ্ট আরও রেড়ে যাবে। স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা বড় মেয়ে শেখ হাসিনার জন্য পাত্র দেখেন, তখন শেখ মুজিবুর রহমান নানা চিন্তাভাবনা করে কন্যার বিবাহতে মত দেন। বিয়ের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে বলেন, তোমার মা যাহা বলে শুনিও। কথাটির গুরুত্ব অপরিসীম। শেখ মুজিব কন্যার জন্মের সময় কলিকাতায় দাঙ্গা নিরসনে ব্যস্ত ছিলেন আবার বিয়ের সময় পাকিস্তানি কারাগারে রাজবন্দি। দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব যেন তাঁর আজন্ম।
বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি। এ সময় দেশে প্রবল উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। বঙ্গমাতা দেশের মানুষের পালস্ বুঝতেন। তাই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে আপসের ব্যাপারে দৃঢ় হতে বলেছিলেন। শেখ মুজিব কথা রেখেছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি হন বঙ্গবন্ধু তথা দেশের বন্ধু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা রেণুর অপরিসীম অবদানের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয়।
জেলের বাহিরে যতটুকু সময় পেয়েছেন স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি যত্নশীল ছিলেন শেখ মুজিব। আদর্শ পরিবারে বিশ^াসী ছিলেন তিনি। সন্তানরা যেন কুসন্তান না হয় তাঁর প্রতি নজর ছিলো। একজন আদর্শ স্বামী, স্নেহশীল পিতা ও মানব দরদী হিসেবে আমরা শেখ মুজিবকে দেখতে পাই। সংসার জীবনেও তিনি সফল ছিলেন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh