× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভায় বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের কিছু কথা

অধ্যাপক ড. জসীমউদ্দীন

১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:০২ এএম

১৯৭১ সালেরর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটের সময়ই বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডিস্থ নিজবাসা থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। গ্রেফতারের তিনদিন পর ২৯ মার্চ তাঁকে বিমানযোগে পাকিস্তান নিয়ে যায় এবং লায়ালপুর জেলে আটক রাখে। পরবর্তী নয় মাস তিনি এ জেলখানাতেই বন্দি ছিলেন। বন্দি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার আয়োজন করে তাঁকে ফাঁসি দেয়ার উদ্যোগ নেয় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তা আর করতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পন করে। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তির পর রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরেন জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরর হমান।


সেদিনই বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। দীর্ঘ নয় মাসের নিঃসঙ্গ কারাজীবন, বিচারের প্রহসন, নিজের কবর দেখা, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত ফাঁসি দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি স্বপ্নের বাংলাদেশ ও সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্যের কথা ভাবতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেহ হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত। কিন্তু মুখ ছিল সজীব প্রসন্ন। রেসকোর্স ময়দানে তিনি ছিলেন আবেগ আপ্লুত। বারবার তাঁর দুচোখ গড়িয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই তিনি ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে মতামত দেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দেশের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট।

মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিশ লক্ষ স্বজন হারানো বেদনার মাঝেও বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার আনন্দে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এ যেন দীর্ঘ অমানিশার পর নতুন সূর্যোদয়। সারা বাংলাদেশ আনন্দে উদ্ভাসিত, জেলে, মুঠে, মজুর, ছাত্র, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, গৃহবধূ, বস্তির ছেলে সবার মুখে হাসির রৌদ্র। জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং স্বাধীন থাকবে। একজন বাঙালী জীবিত থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। একটিসুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সাত কোটি বাঙালির প্রতি তিনি আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে জনগণ কিছু সময়ে রজন্য ভুলে যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সব লাঞ্ছনা, অবমাননা, উৎপীড়ন, নিপীড়ন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জানতাম না বাংলার মাটি আর মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে, কিন্তু আমার বহু ভাইকে আমি আর এ জীবনে দেখতে পাবনা...। তাঁদের এই রক্তদান বিফলে যাবেনা- যেতে দিবনা।’ জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন ‘ সোনার বাংলার মানুষ আবার হাসবে, খেলবে, সোনার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে- ইহাই আমার কামনা। অশ্রু সজল কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার যে সন্তান, যে কৃষক, যে শ্রমিক, যে ছাত্র ও যে যুবক সংগ্রাম করেছে, তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধাজানাই এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তানি নরপিশাচ বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ লোককে হত্যাকরেছে। “আমি জনতাম না যে আমি বর্বও পাকিস্তান বাহিনীর জেল খানাহতে ফিরে আসতে পারব। আমার কবর ও তারা তৈরি করে রেখেছিল। আমি তাদের শুধু একটি অনুরোধই করেছিলাম- আমার লাশ বাংলাদেশে ফিরাইয়া দিও”।  আমি ফাঁসির কাষ্ঠে যাবার জন্য প্র¯‘ত ছিলাম। কিš‘ আমি জানতাম বাঙালিকে কেউ দাবাইয়া রাখতে পারবে না। আজ সত্যিই বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘যারা অন্যায় করেছে, লুট করেছে, হত্যা করেছে, পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সহযোগীতা করেছে, তাদের বিচার হবেই, কেউ রেহাই পাবেনা’
তিনি বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বেও দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হলে ও ইহা হবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

বাংলাদেশ ও ভারতের ভ্রাতৃত্ববন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে। ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি যে সহযোগিতার মনোভাব দেখিয়েছে তা ই হচ্ছে দু’দেশের দৃঢ় সম্পর্কেও ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা এবং তাঁরপ্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ করে বলেন, বিশ্বেও এমন কোনরাষ্ট্র বারাষ্ট্র নেতা নেই যার কাছে তিনি তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) মুক্তির জন্য অনুরোধ জানান নাই। মেহনতী জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি অকাতরে জেল জুলুম সহ্য করেছেন। শত্রুর অন্ধকারা”ছন্ন, নি:সঙ্গ কারাবাসে থেকেও তিনি বাংলার নিপীড়িত মানুষের কথা ভেবেছেন। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করলেই বাঙালী জাতিকে পদানত কওে রাখা যাবে। কিš‘ তাদের জানা ছিলনা যে, কারাগার বন্দি বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে অকার্যকর কওে রাখতে পারলে ও তাঁর আদর্শেও বিস্তার রোধ করতে অক্ষম। যার ফলে একজন বন্দি মুজিব থেকে সাড়ে সাত কোটি মুজিব আদর্শেও বিস্তার হয়েছে। জীবনের মৃত্যু আছে কিš‘ আদর্শেও মৃত্যু নেই।

বঙ্গবন্ধু বলেন, মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, ও জীবন ধারণের জন্য নূন্যতম প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যব¯’া করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে তার ব্যাপকতা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন করা হবে। দেশের বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত চলছে উল্লেখ কওে তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য জনসাধারণকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। পাকিস্তানের সাথে একটি শিথিল সম্পর্ক রাখার যে প্রস্তাব ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল তা তিনি প্রত্যাখান করেন। বঙ্গবন্ধু হুশিয়ার করে ভুট্টোকে বলেন, সে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণের জন্য কোন ষড়যন্ত্র না করে। বঙ্গবন্ধু বলেন‘ তোমরা স্বাধীন, আমরাও স্বাধীন। স্বাধীন রাষ্ট্রে হিসেবেই তোমাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক থাকবে’। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, বৃটেন এবং অনান্য বন্ধুসুলভ দেশ যারা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে তাদের সরকার ও জনসাধারণকে তিনি মুবারকবাদ জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্টের জনগণ ও সংবাদপত্রকে ও তিনি ধন্যবাদ জানান। মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর উ”ছ¡সিত প্রশংসা কওে তাঁদেরকে অভিনন্দন জানান। সবশেষে বলা যায়-বঙ্গবন্ধু সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ষড়যন্ত্র যাকে বারবার ঠেলে দিয়েছে বাধা বিপত্তির ঘূর্ণাবর্তে। কিন্ত ইতিহাস তাঁকে টেনে তুলেছে আপন হাতে। বসিয়েছে গৌরব ও সাফল্যের উচ্চাসনে।

লেখক: ড. জসীমউদ্দীন, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।




Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.