× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ

ড. মাহফুজা হিলালী

১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৫:৫৬ এএম । আপডেটঃ ১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:২৩ এএম

দুপুর আড়াইটা; ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বন্দি মুজিব ফিরলেন স্বপ্নের স্বাধীন স্বদেশে। ৩০৫৩ দিন কারাগারে কাটিয়েছিলেন কেবল এই দিনটির অপেক্ষায় বাংলার স্বাধীনতা। সেই কাঙ্খিত স্বাধীন দেশে দেশের স্থপতির প্রত্যাবর্তন ঘটলো। বিমানবন্দর তখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তিনি চলে যান রেসকোর্স ময়দানে। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ তাঁকে দেখার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। পিতা ফিরেছেন দেশে। তারা জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু খোলা জিপে দাঁড়িয়ে সবাইকে হাত নেড়ে ভালোবাসা জানান। তখন তাঁর চোখ দিয়ে আনন্দ-অশ্রু পড়ছিলো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে! আর কেউ এ দেশকে ‘দাবায়ে’ রাখতে পারবে না।

বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ মানুষের সামনে এসে দাঁড়ান স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কী বলবেন তিনি! কী বলবার আছে তাঁর! পরাধীন বাঙালি জাতিকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন? আরও দায়িত্ব কি তিনি কাঁধে তুলে নেবেন! জনতার সামনে এসে তিনি বলেন: “আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না।” আহা, বঙ্গবন্ধু এক জীবনে কতো কিছু দিতে চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে! প্রথমেই তিনি বাংলার মানুষের পাশে ভাইয়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেনÑরাষ্ট্রপতি না নেতা হিসেবে নয়। বলা বাহুল্য, পরবর্তী দিনগুলোতেও তিনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, বাঙালি মধ্যবিত্ত একজন মানুষের মতোই দিনযাপন করেছিলেন। হ্যাঁ, প্রথম দিন এসেই ভাষণে স্বাধীনতার পূর্ণতার কথা বলেছিলেন তিনি। শুধু মানচিত্র আর বাঙালির হাতে শাসনভারই যথেষ্ট নয়, সমস্ত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসতে হবে। তবেই পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। এই সত্য অনুভব করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই অংশে তিনি তিনটি বিষয় বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের আশ্রয়, খাদ্য, আর চাকরি। পরাধীন মানুষগুলোকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেওয়ার জন্য, খাদ্যের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য তিনি বদ্ধ পরিকর ছিলেন। তিনি রাজনীতি করতেন সাধারণ মানুষের জন্যই। নিজের অথবা রাজনৈতিকদের আখের গোছানোর জন্য নয়। যদি ক্ষমতার লোভ তাঁর থাকতো তাহলে তিনি আইয়ুব খানের প্রস্তাবমতো ছয় দফা বাদ দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর হয়ে যেতেন। কিন্তু ক্ষমতা নয়, তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ, চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের সুখ। তাই স্বদেশে ফিরে প্রথমেই তিনি সেই সাধারণ মানুষের কথাই বলেছিলেন। তাদের আশ্রয়, খাদ্য, চাকরি এসবের কথা। নাও তো বলতে পারতেন। শুধু স্বাধীনতা এনে দেওয়ার অহংকারে কথা বলে দায় সাড়তে পারতেন, সারাজীবনের কষ্টের কথা বলে বাহবা কুড়াতে পারতেন। তা তিনি করেননি। স্বাধীনতার পূর্ণতার বিষয়ে কথা বলেছিলেন। এখানেই তিনি পিতা, এখানেই তিনি স্থপতি, এখানেই তিনি মহানায়ক।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না।” যথার্থ পিতার মতোই বলেছিলেন তিনি। তাঁর ইচ্ছে এবং সংকল্প তাই ছিলো। নিজের ইচ্ছের কথা তিনি বলেছিলেন এভাবে “গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম, ‘দুর্গ গড়ে তোল।’ আজ আবার বলছি, ‘আপনারা একতা বজায় রাখুন।’ আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব।’ বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নাই।” মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব সম্পর্কে বলেন, “মার্চের সেই রাতে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় আমার সহকর্মী তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ও অন্যরা কাঁদছিলেন। কিš‘ আমি বলেছি, এখানে আমি মরতে চাই। তবুও মাথা নত করতে পারব না। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা নির্দেশমত সংগ্রাম চালিয়ো। তারা সে ওয়াদা পালন করেছে।” এখানে বোঝা যায়, তিনি শুধু বড়ো নেতাই ছিলেন না, দূরদর্শীও ছিলেন। তাই নেতৃত্ব তৈরিও করেছিলেন, যেন তাঁর অবর্তমানে অন্য নেতারা কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জন করতে পারেন। সত্যিই তা ঘটেছিলো। যুদ্ধের নয় মাস কেউ জানতেন না বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি-না। তবু কেউ হাল ছাড়েননি। নেতার নির্দেশে এবং নির্দেশনায় তাঁরা দেশকে স্বাধীন করে ছেড়েছিলেন। এ কথার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কৃতজ্ঞ মনেরও পরিচয় পাওয়া যায়। নিজের কথা তিনি ফলাও করে বলেননি, তাঁর সহকর্মীরা যে একাগ্রতা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন, সে কথা কৃতজ্ঞচিত্তে বলেছিলেন তিনি। তাঁর কথায় কি শুধু কৃতজ্ঞতা ছিলো? না, মুগ্ধতা ছিলো, ছিলো বিস্ময়তা। সত্যিই এ এক বিস্ময়; ‘বং’ জাতি পরাধীন হয়েছিলো খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে। তারপর কতো কতো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে পৌঁছেছে সেই বং বা বাঙালি জাতি। তাঁরা একটি স্বাধীন দেশ অর্জন করেছে। কোনো বৈঠকে বসে আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা স্বাধীনতা পায়নি। সংগ্রাম-আন্দোলন করে, বুকের রক্ত নিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে স্বাধীনতাকে অর্জন করতে হয়েছে। আর এই স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। কোনো নেতার দেখানো স্বপ্ন বাস্তবায়ন নয়। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন। তাই স্বপ্নপূরণে তিনি বিস্মিত-অভিভূত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। বিস্মিত হয়েছিলেন নিজেকে জীবিত দেখেও। যারা ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে পারে, তারা এক মুজিবকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো! এ এক বিস্ময়কর বাস্তবতা। এতেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর শক্তি।  
        
স্বাধীন দেশে প্রথম ভাষণ বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন এভাবেÑ“যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যাঁরা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাঁদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। ভাইয়েরা আমার, লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও। আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দান ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটেন, জার্মানি, ফান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।”

এই কথায় বঙ্গবন্ধুর কৃতজ্ঞ মনের প্রতিফলন আরও বেশি করে পাওয়া যায়। যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততোটুকু দিতে তিনি ছিলেন উদার। তাই প্রথমেই তিনি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন শহীদদের প্রতি। তারপর দেশের মানুষ এবং বিদেশিদের প্রতি। এখানে তিনি তাঁর জীবনের সাধনার কথাও উল্লেখ করেছেন। তা তো ঠিক একনিষ্ঠ সাধক না হলে স্বাধীনতা আনা সম্ভব ছিলো না। তখন তো রাজনীতি করা এক ধরনের সাধনাই ছিলো। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হবার সাধনা। সত্যিই বঙ্গবন্ধু সাধক ছিলেন। সমস্ত জীবনটাই তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছেন। ব্যক্তিগত কোনো লোভ-লালসা বা উচ্ছাকাঙ্খার জন্য নয়। তিনি প্রথম দিনে এও বলেছিলেন যে, “এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্ব প্রথম তাঁর প্রাণ দেবে।” স্বাধীনতা রক্ষা করবার দৃঢ়তা তাঁর এতোটাই ছিলো। তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।” তিনি একতার কথা বলেছিলেন, তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলেন। একতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলে যে কোনো কাজে সফলতা আসবে। একতাই একটি জাতিকে উ”চশিখরে নিয়ে যেতে পারে। কারণ একতা থাকলে উন্নয়ন হবেই। আর এর সাথে যদি যুক্ত হয় জাতীয়তা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র তাহলে স্বাভাবিকভাবেই দেশ এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু এভাবেই পরিকল্পনা করেছিলেন। ওই যে তিনি বলেছিলেন সাধনার কথা। তাঁর সাধনালব্ধ জ্ঞানেই তিনি রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি ঠিক করেছিলেন। এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিলো খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। বলাবাহুল্য তা কার্যকর হলে দেশ আজকে ‘উন্নত শির’-এ দাঁড়িয়ে থাকতো। দেশকে তিনি কোন দিকে নিয়ে যাবেন, তার ইংগীত তিনি এই ভাষণেই দিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, “বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরাই সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। যার যার কাজ করে যান।” এই যে বলেছিলেন ‘যার যার কাজ করে যান।’ এর মধ্য দিয়ে তিনি সবার দায়িত্ব পালনের কথা বলেছিলেন। এ কথা বলেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্তদের। দেশ গড়ে তোলার জন্য সকলের সম্মিলিত শক্তি প্রয়োজন ছিলো। তাই বঙ্গবন্ধু নিজেদের কাজ ঠিকভাবে করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন। যার যার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে সব কিছুর সুসমন্বয় হয়। সুসমন্বিত কাজ সব সময় সুফল বয়ে আনে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিলো সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ে তোলার। দেশ গঠনে তিনি এই সুসমন্বয় কামনা করেছিলেন। এই ভরসায়ই হয়তো তিনি বলেছিলেন, “তোমরা, আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্যে। তোমরা রক্ত দিয়েছ। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না।” এ কথা ঠিক যে, একা যেমন একটি জাতির স্বাধীনতা আনা যায় না, তেমনি একা দেশ গড়ে তোলাও যায় না। সম্মিলিত চিন্তা, সম্মিলিত চেষ্টাই লক্ষে পৌঁছে দেয়। বঙ্গবন্ধু তাই একতার কথা প্রথমেই বলেছিলেন। আজকে এ কথা চিন্তা করে বিস্মিত হতে হয়। নয় মাস বন্দিদশা কাটিয়ে দেশে এসেই তিনি আবার নির্দেশনা দেওয়া শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বভাবেই ‘মাতৃমন’ ছিলো। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখতে চান, তিনিও তেমনি করে বাঙালিকে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। তাই কারো কোনো চাহিদার কথা না শুনেই, বা কোনো কথা না শুনেই তিনি দিকনির্দেশনা দেওয়া শুরু করেছিলেন। তিনি মনেই করতেন যতোক্ষণ তাঁর জীবন আছে, ততোক্ষণ তিনি বাঙালি জাতির ভালো-মন্দ দেখবেন। তিনি যে পিতা! তাই তো বলতেন ‘আমার বাঙালি।’

রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তাদের জানি। ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এদের বিচার হবে। সে ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখুন।” রাজাকারদের বিচার করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। শুধু রাজাকারদের বিচারই নয়, পাকিস্তানের বিচারের জন্যও তিনি ছিলেন সো”চার। তাই তিনি বলেছিলেন, “ওরা আমার লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, এমন গ্রাম নেই যেখানে আগুন দেয় নাই, যেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই। আজ বহু ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী ও সহকর্মীকে আমি দেখছি না। এত বেসামরিক লোককে হত্যা করার নজির আর নাই। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত বেসামরিক লোক মরে নাই।” এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, “গত ২৫ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এ সব ঘটনার সামান্য কিছুমাত্র জানে।

বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি জানাচ্ছি।” এতে বোঝা যায় তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিচার চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রতি অভিযোগ জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম এবং ভারত তৃতীয়। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে।” এ কথার মাধ্যমে বিশ্বকে এক মহা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মুসলিমরাই মুসলিমদের হত্যা করেছে। এবং তা ইসলামের নামে। ধর্মের নামে এই রাজনীতি তিনি পছন্দ করেননি। তাই তিনি রাষ্ট্রের মূলনীতিতে এনেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা। এবং মানুষকে বিশেষত বিশ্ববাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানিরা কীভাবে ধর্মের নামে মানুষহত্যা করেছিলো। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই অংশ তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়বাহী। তিনি পাকিস্তানিদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচন করেছিলেন।      

তবে বঙ্গবন্ধু আটকেপড়া বিহারিদের সম্পর্কে নমনীয় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা যারা বাংলায় কথা বল না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও। ভাইরা, তাদের গায়ে হাত দিও না; তারাও আমাদের ভাই। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই, বাঙালিরা কেবল স্বাধীনতার জন্যেই আত্মত্যাগ করতে পারে, তাই না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে।”


ভারত সম্পর্কেও তিনি সন্দিহান ছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেশে ফেরা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে সংশয় ছিলো। তাই তিনি লন্ডন থেকে সরাসরি দেশে না এসে দিল্লি গিয়েছিলেন অবস্থা বুঝতে। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী না উঠলে তো স্বাধীনতা আসবে না। তাই তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। এবং নিশ্চিত হয়ে এসেছিলেন যে, সেনাবাহিনী চলে যাবে। তিনি ভাষণে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পেরেছিলেন, “ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্যা, পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নাতনি। তাঁর রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্যে আবেদন করেছেন। আমার সাথে দিল্লিতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।”    
 
তিনি দেশকে এতো ভালোবাসতেন যে মৃত্যুর পরও বাংলার মানুষের কাছে আসার চিন্তা করতেন। তিনি এসে জানিয়েছিলেন, “ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়াছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তাদের আরও বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিš‘ আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।” আর দেশে ফিরে বললেন, “আজ আমি বলতে চাইÑভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সাথে আর না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।” বিশ্বের স্বাধীন দেশগুলোকে তিনি স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। জাতিসংঘেরও উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সংগত দাবি পূরণ করা।” এই কথায় স্পষ্ট বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু নত শিরে কাকুতি-মিনতি করেননি। বাংলাদেশের অধিকারের কথা বীরদর্পে জানিয়েছিলেন।     

বঙ্গন্ধু তাঁর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার জন্য মনে মনে ব্যথিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,/রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ তাই দেশে এসেই তিনি কবিগুরুর এই কবিতার জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।”

এই ভাষণে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উ”চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, “ঘুষ লেনদেন করা যাবে না। ঘুষ বন্ধ করা হবে।” তিনি তো জানতেন ঘুষ-দুর্নীতি থাকলে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ন্যায়-নীতি না থাকলে আর স্বাধীনতা এলো কী করে! এতে তো সাধারণের মুক্তি হবে না! তাই তিনি প্রথম দিনে এ সম্পর্কেও বলেছিলেন।  

প্রথম দিনের এই বক্তব্যে তাঁর অনুভূতি বোঝা যায়। দেশকে তিনি কোন দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তাও বোঝা যায়। কৃষক-শ্রমিককে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টিও বোঝা যায়। বোঝা যায় দেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই সারা জীবন চেষ্টা করেছিলেন। আর একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তিনি পাকিস্তানিদের বর্বরতার বিচার চেয়েছিলেন। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে সব প্রসঙ্গ এনেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলোÑএকতার মধ্যেই মূল শক্তি,  প্রকট খাদ্যসমস্যা সমাধানের চেষ্টা, কবিগুরুর আক্ষেপ মোচন, দেশ গড়ার প্রত্যয়, শান্তিতে থাকার প্রত্যয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ঘোষণা, তাজউদ্দিন-সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমূখ সহকর্মীদের ওপর সন্তুষ্টি, যার যার কাজ করে যাওয়ার আহ্বান, বেসামরিক লোককে হত্যার এমন নজির ইতিহাসে নেই বলে মন্তব্য করে পাকিস্তানের তীব্র সমালোচনা, দেশের ভিত্তি ধর্মভিত্তিক হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করা, খাদ্যের অভাবে দেশের লোককে মরতে দেবেন না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা, ঘুষ বন্ধ করার ঘোষণা, বিশ্বকে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের তদন্ত করার আহ্বান জানানো ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশকে কেমন দেখতে চান, কিংবা বলা যায় কী রকম দেখবেন বলে তিনি জাতির স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তার একটি ভূমিকা কিংবা সারাংশ যেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর এই ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি দেশ চলতো তা হলে আজ সত্যিই দেশ সোনার দেশ-এ পরিণত হতো। কিন্তু তাঁকে হত্যার মাধ্যমে দেশ সেই সুনিশ্চিত উন্নয়ণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং বাঙালি হয়েছে পিতৃহন্তা জাতি।    

টীকা: বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এর ভাষণ নেওয়া হয়েছে আবুল মাল আবদুল মুহিত, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, মো. জাহিদ হোসেন সম্পাদিত এই দেশ এই মাটি : প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, ঢাকা: বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ২০০৮ বই এর ১৬৩ থেকে ১৬৫ পৃষ্ঠা থেকে।

লেখক: গবেষক ও নাট্যকার; সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।






Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.