× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

১৯৭১ : কেন্দ্রের ইতিহাস বনাম প্রান্তিক ইতিহাস

আফসান চৌধুরী

১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০৪ এএম

যেকোনো দেশের জাতীয়  ইতিহাসের দুটি অংশ থাকে। একটি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় অংশ। এটি হয় কাঠামোভিত্তিক। অন্যটি হয় সামাজিক ইতিহাস, যা জনগণভিত্তিক হয়ে থাকে। অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর ইতিহাস। এ উভয়ই মিলে তৈরি হয় জাতীয় ইতিহাস। আমাদের দেশের জন্মগ্রহণের ইতিহাস চর্চার সমস্যা হচ্ছে যে, আমরা যদিও প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় ইতিহাস সম্পর্কে খুব একটা সজ্ঞ নই। বাংলাদেশে প্রায় ছয়-সাত হাজার বই লেখা হয়েছে ১৯৭১ সালের রাষ্ট্র গঠনের ওপর; কিন্তু বেশির ভাগ সীমিত রয়েছে সেসব মানুষের ইতিহাস নিয়ে, যেগুলো প্রধানত সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক। সাধারণ মানুষের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসের বই খুঁজতে গেলে আমরা খুব একটা পাব না। এরফলে আমাদের নিজ দেশের জন্মকালের সম্পর্কিত ধারণা কিছুটা একপেশে হয়ে গেছে।
২.
 প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ইতিহাস প্রধানত ক্ষমতাবানদের ইতিহাস হয়ে থাকে। আর সামাজিক ইতিহাসের অবস্থাটা হচ্ছে উল্টো। ফলে স্বল্পসংখ্যক মানুষ, যারা ক্ষমতার বলয়ের অভ্যন্তরে বসবাস করে তাদের কথাই জানা যায়। অন্যদিকে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ক্ষমতার বলয়ের বাইরে বসবাস করে। তাদের যেকোনো ভূমিকা আছে রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে, সেটি নিয়ে খুব একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। একটি নিরন্ন গ্রামের নিরন্ন মানুষ কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে এটা আমরা ভাবি না। তাই এ প্রান্তিকতা জন্মায়। ইতিহাস ভাবনা এবং চর্চার ক্ষেত্র এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে আমাদের জানা সীমিত হয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। তার মানে একটি দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের ইতিহাস অজানা রয়ে যায়, যারা মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।

৩.
আমরা যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের কাজ করছি ( ১৯৭৮-১৯৮৪ ), তখন আমাদের সংগ্রহের দিকে তাকালেই এ বিষয়টি চোখে পড়ে। অর্থাৎ আমরা রাজনীতিবিদ, মুজিব সরকারের আমলা, সেনাবাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র মানুষ, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং এ ধরনের অন্যদের দলিল সংগ্রহ ও সন্নিবেশিত করি। একটি খন্ডে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা সংগৃহীত রয়েছে। কিন্তু বাকী ১৪ খন্ডে সাধারণ মানুষের কথা  নেই। থাকলেও স্বল্পভাবে আছে। এতে বোঝা যায যে, কেন্দ্র ও প্রান্তিক যে বিষয়টি, সেটি দলিলপত্রভিত্তিক ইতিহাসের মধ্যেও এসে পড়ে। ইতিহাসচর্চার যে সনাতনী ধারা সেটির অনুসরণ করলে এই কেন্দ্র ও প্রান্তিকতার সমস্যা থাকবেই।

৪.
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করতে গিয়েই এ ভাবনাটা আমার সবল হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল, দলিলভিত্তিক ইতিহাস মানেই হচ্ছে শিক্ষিত ও ক্ষমতাবান মানুষের ইতিহাস। এতে সাধারণ মানুষের বা প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আমি কেন্দ্রের ইতিহাসের বিপক্ষে নই। তবে মনে করি, প্রান্তিকের ইতিহাস না থাকলে জাতীয় ইতিহাস অসম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং জাতীয় ইতিহাস হিসেবে দাবি করার অধিকারও দুর্বল হয়। সে কারণেই প্রান্তিকের ইতিহাস জানার প্রয়োজন রয়েছে সবার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক  প্রান্তিক জনগণ বাস করে গ্রামে; কিš‘ তাদের ইতিহাস নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশের বেশির ভাগ ঘটনাই শুধু গ্রামে ঘটেনি, বরং যুদ্ধও ঘটেছে গ্রাম পর্যায়ে। অর্থাৎ ইতিহাসের মূল মঞ্চ, ঘটনাগুলো আমাদের জাতীয় মঞ্চে খুব ঝাঁপসাভাবে দেখা যায়।

৫.
 দু’হাজার সালের দিক থেকে আমরা গ্রামের ইতিহাস সংগ্রহ শুরু করি। এর মানে গ্রামে গিয়ে অবস্থান করা এবং গ্রামের মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। এই পদ্ধতিটি সহজ নয়। কারণ গ্রামের মানুষ সবাইকে সবকিছু বলে না। আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়াটি এজন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি আমাদের মাঠ পর্যায়ের গবেষকরা অর্জন করতে সফল হন এবং প্রথম পর্যায়ে গ্রামের ইতিহাসের পদচিহ্নাবলি আমরা দেখতে শুরু করি। লক্ষণীয় যে, গ্রামের ইতিহাস মানে, তার সামগ্রিক ইতিহাস। এই ৯ মাসে তার গোটা জীবনযাপন মরা-বাঁচার ইতিহাস। অতএব, গ্রামের ইতিহাস সে অর্থে অনেক বেশি সামগ্রিক  বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। সেটি সংগ্রহ করা অনেক বেশি দুরুহ এবং সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া যে কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয় এবং যে কোনো দাবি গ্রহণযোগ্য  কি না, সেটি সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় ক্ষমতাবানদের স্মৃতিচারণগুলো পড়তে গিয়ে আমাদের কোনো উপায় থাকে না যাচাই করার। কিছু ক্ষেত্রে এর কারণে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।  যেটি বাংলাদেশের বাস্তবতায় ঝগড়াঝাটি মারধর পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু গ্রামগুলো সেদিক থেকে নিরাপদ। কারণ মিথ্যা কথা বা অবাস্তব দাবিকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করার  লোক গ্রামের মধ্যেই থাকে। সে অর্থে গ্রামের ইতিহাসচর্চা আমার অভিজ্ঞতায় অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ হয়। একই সঙ্গে গ্রামে যত রাজনীতিই থাকুক, সেখানে তথ্যবাণিজ্যটা কম। আমি এটা করেছি, ওটা করেছি বলে খুব কমই মানুষ দাবি করে। অন্যদিকে কোনো মানুষের বক্তব্য যদি উদ্ভট বা অসত্য বলে অন্যদের মনে হয়, তারা সেটা জানায়। সে কারণেই গ্রামের ইতিহাস অন্তত আমার কাছে বেশি নির্ভরযোগ্য অনেক কেন্দ্রীয় চরিত্রদের ইতিহাস থেকে।
৬.
 বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রধানত হয়েছে গ্রামেই। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল গ্রামে। এক অর্থে বাংলাদেশ ছিল একটি গ্রাম। শহরে যুদ্ধ হয়েছে বা ঘটনা ঘটেছে। কিš‘ গ্রাম হচ্ছে সেই পরিসর যেখানে মানুষ তার জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করেছে আগামী বাংলাদেশ; কিš‘ গ্রামের মানুষ লিখে না বা লিখতে পড়তে জানে না অথবা ক্ষমতার কাছাকাছি বসবাস করে না। তাই তাদের কথা জানার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম। ফলে বেশিরভাগ মানুষের ইতিহাস আমাদের অজানা রয়ে গেছে। আমরা মনে করি, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের মতো দেশের বসবাস তাতে এটা হওয়াই স্বভাবিক। এটি কেবল যে গ্রামের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঘটেছে তা নয়। এটি প্রযোজ্য বিত্তহীন মানুষের ক্ষেত্রে, নারীর ক্ষেত্রে, সংখ্যালঘু মানুষের ক্ষেত্রে।

সবাই মিলে দেশ স্বাধীন করেছে। তাই সবার ইতিহাস জানা আমাদের দায়িত্ব। গ্রামের ইতিহাস কেবল যুদ্ধ বা অস্ত্রের ইতিহাস নয়। এটি সেই বছরের  বেঁচে থাকা-টিকে থাকারও ইতিহাস। এই সামগ্রিকতার সন্ধানেই আমরা গ্রামে গিয়েছি। একটি গ্রামের ইতিহাস গোটা বাংলাদেশের ইতিহাস নয়। কিš‘ গোটা গ্রামের ইতিহাস মিলেই বাংলাদেশের ইতিহাস। গ্রামেই বাংলাদেশের ’৭১ সালে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি। গ্রামের ইতিহাস জানাই বাংলাদেশের ইতিহাস জানা। সে কারণেই আমরা এ চর্চাটা করেছি গত ২০ বছর ধরে। এ প্রসঙ্গে বলছি, প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বয়ানের ওপর যে ইতিহাস রচিত হবে তা বস্তু‘নিষ্ঠ ও সত্যনিষ্ঠ, কারণ তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই।  তাদের ভাষায়, তাদের বক্তব্য সামনে নিয়ে আসা-বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায় অনেকটাই সহজ হবে। আমরা সেই কাজটাই করছি।  

আফসান চৌধুরী : সাংবাদিক ও গবেষক।

   


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.