× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৫:০৪ এএম

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো। একটি ভারত ইউনিয়ন এবং অন্যটি পাকিস্তান। ভারতবর্ষ আসলে বহুজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল। তাই একে কেউ কেউ বলেন উপমহাদেশ। এই উপমহাদেশে শুধু বহু জাতি নয়, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি ও বহু ধর্মের অস্তিত্ব। অথচ তাকে দ্বিখণ্ডিত করা হলো মধ্যযুগীয় ধর্মীয় জাতিতত্ত্বের একটা প্রচ- ভ্রান্তিকে ভিত্তি করে। এই ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রধান উদ্গাতা মি. মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্। কিš‘ তার পরিকল্পিত পাকিস্তানের মূল প্রস্তাব, যা লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত, তাতেও ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব এবং ভাষা ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্যের জন্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত ও পূর্বাঞ্চলে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল, একটি নয়। ভারত ভাগ হওয়ার মুখে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে জিন্নাহ্ সুকৌশলে লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেটস’ কথাটি বদলে ‘স্টেট’ করে নিলেন। শুরু হলো পাকিস্তানে জাতি-শাসন ও শোষণ প্রতিষ্ঠা এবং বহু দূরবর্তী বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করে রাখার অপচেষ্টা। বাংলাদেশে মুসলিম লীগের কর্তৃত্ব তখন ছিল উর্দুভাষী ঢিউডাল নেতৃত্বের হাতে। তারা সহজেই উপনিবেশের নেটিভ উপশাসকের ভূমিকা গ্রহণে রাজি হলেন এবং আত্মসমর্পণ করলেন পশ্চিম পাকিস্তানি পলিটিক্যাল কাম বুরোক্রাট শাসক চক্রের কাছে।

মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে যে প্রগতিশীল অংশটি ছিল শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে, তার প্রবীণ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূতের পদ পেয়ে শাসকচক্রের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন বটে, কিন্তু তরুণ নেতাদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নাম শেখ মুজিবুর রহমান। মুসলিম লীগের ফিউডাল ও প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে এরা প্রথমে গঠন কলেন মুসলিম লীগ কর্মী শিবির এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগও আলাদা হয়ে গেল দলের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ থেকে। এটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে ১৯৪৮ এই বছরটি রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল।

এই বছরই তিনটি প্রধান ঘটনা ঘটলো বাংলাদেশে বা তার ইতিহাসকে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করলো।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, এলেন ঢাকায় রাজকীয় সফরে। তখন তিনি পাকিস্তানের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান বা গভর্নর জেনারেল। ঢাকার জনসভায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোসণা করলেন, ‘উর্দু-উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহ্ সাহেব হয়তো ভেবেছিলেন, কয়েক শতাব্দী আগে বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণ করতে এসে সংস্কৃত ভাষাভিমানী ব্রাহ্মণ শাসকেরা যেমন ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘বাংলা রৌরব নরকের ভাষা’ এবং অত্যাচার শুরু করেছিলেন বাংলাভাষাভাষী স্থানীয় লোকদের ওপর-যার পরিণামে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু নিদর্শন নিয়ে তারা পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশি নেপাল ও অন্যান্য দেশে; বিশ শতকের মধ্যপাদেও তার ঘোষণায় পাকিস্তানের নেটিভ বাঙ্গালী প্রজারা তা-ই করবে। কিন্তু তা হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে একটি বিদ্রোহী কণ্ঠ জিন্নার ঘোষণার উত্তরে গর্জে উঠলঃ না, না, না। বাংলাদেশে শুরু হলো মধ্যযুগীয় অত্যাচার, গ্রেপ্তার, গুলি,  নির্যাতন,  হত্যা। গঠিত হলো প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। প্রতি বছর ১১ই মার্চ তারিখে সারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হতে লাগল ১৯৫২ সাল পর্যন্ত। একই বছরে ঘটল আরেকটি ঘটনা। আইয়ুব খাঁ তখন উপনিবেশ বাংলার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জি, ও, সি। বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে তার তীব্র ঘৃণা। তাঁর আত্মজীবনী ‘প্রভু নয় বন্ধু’ পুস্তকে তিনি বাঙ্গালীদের বর্ণনা করেছেন ‘বেটে ও কালো’  এই দুই বিশেষণ দ্বারা। এই সময় কয়েকটি দাবী দাওয়ারর ভিত্তিতে বাঙ্গালী পুলিশ ধর্মঘট করলং। ঢাকার লালবাগ থানা (যা আবার লালবাগ দুর্গেই অবস্থিত ছিল) হলো তাদের হেড কোয়ার্টার।

আইয়ুব ভার নিলেন ধর্মঘটী বাঙ্গালী পুলিশদের শায়েস্তা করার। আলোচনার নামে তিনি সকল ধর্মঘটী পুলিশ-নেতাকে ডেকে পাঠালেন লালবাগ দুর্গে। ততক্ষণে সৈন্যবাহিনী পজিসন নিয়েছে দুর্গের চারপাশে। সরল ও সহজ বাঙ্গালীরা কিছুই বুঝলো না। তারা ফাঁদে পা দিল। অতর্কিতে গুলি বৃষ্টি শুরু হলো চারদিক থেকে। রক্তে লাল হয়ে গেল লালবাগ দুর্গের সবুজ মাটি। অসংখ্য পুলিশ শহীদ হলো আক্রমণে বাধা দেবার প্রস্তুতির আগেই। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দিনটি ছিল পয়লা রমজান। মুসলমানদের কাছে অতি পবিত্র মাস ও দিন। এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যে সভা হলো ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে তাতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেদে ফেললেন বাংলার তখনকার তরুণ রাজনৈতিক নেতারা। একজন প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের শাসকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন-‘তোমরা কেমনতরো ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান শাসক? তোমরা পবিত্র রমজান মাসকেও মোহরমের মাসে (ইসলামের ইতিহাসে শোকের মাস) পরিণত করতে দ্বিধা কর নি ধর্মীয় দিত্বজাতিতত্ত্বের বিভ্রম তখন বাংলাদেশে মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে দূর হতে শুরু করেছে।

তৃতীয় ঘটনাটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নার তিরোধান হলো। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হলেন উর্দুভাষী বাঙ্গালী খাজা নাজিমুদ্দীন। প্রধান মন্ত্রী রয়ে গেলেন নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান। শুরু হলো শুধু বাংলাভাষার বিরুদ্ধে নয়, তার গোটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ও গোপন ষড়যন্ত্র। বেতার ও সরকারি প্রচার মাধ্যম শুরু হলো বাংলাভাষায় বাংলা শব্দ ছাঁটাই অভিযান। এই সময় একটি সরকারি বাংলা সাহিত্য মাসিকে প্রকাশিত প্র”ছদ ছবির নীচে লিখে দেয়া হলো ‘একটি হালখরিদ তাবাহ্কুন।’ অনেক গবেষণা করে বাঙ্গালী পাঠককে বুঝতে হলো, এর অর্থ একটি সদ্য কেনা ডেস্ট্র্রয়ার। কেবল বাংলা ভাষা থেকে বাংলা শব্দ ছাঁটাই করা নয়, সরকারি তহবিলের লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলো, বাংলা হরফের বদলে উর্দু হরফে বাংলা লেখা জনপ্রিয় করে তোলার অভিযান পরিচালনার জন্য। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাঙ্গালি তরুণ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। পরবর্তীকালে আইয়ুব আমলে বাংলা বর্ণমালা ও রবীন্দ্র সঙ্গীত-বিরোধী সরকারি অভিযানও ছিল এই বাংলা সংস্কৃতি উচ্ছেদ পরিকল্পনার অংশ।

একদিকে বাঙ্গালীদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং অন্যদিকে পুলিশ বিদ্রোহ ও ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৪৯ সালে ঢাকা শহরে জন্ম নিল আওয়ামী মুসলিম লীগ বা পরবর্তীকালের আওয়ামী লীগ। প্রথমদিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, শাসকদের কাছে আবেদন-নিবেদন ও প্রতিবাদ জানানোর কর্মসূচী নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলেও পরবর্তীকালে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকেই সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হবে এটা হয়ত সেদিন কেউ ভাবেন নি। ১৯৫০ সালের শেষ দিকেই সম্ভবতঃ লিয়াকত-মন্ত্রিসভা পাকিস্তানের ভাবী সংবিধানের রূপরেখা হিসেবে বেসিক প্রিন্সিপল্স কমিটি বা মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এই রিপোর্টে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পরিষদে কৌশলে সংখ্যাগুরু বাংলাদেশকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ব্যবস্থা ছিল। শুরু হলো বাংলাদেশে অ্যান্টি বিপিসি মুভমেন্ট, যে আন্দোলনের আওয়াজে মুখর। এই সালেই ১৬ অক্টোবর তারিখে পাকিস্তানে আমলাতন্ত্র ও সামরিক চক্রের মিলিত চক্রান্তে রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। গভর্ণর জেনারেল নাজিমুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর পূর্বপদে ইস্তাফা না দিয়েই রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। আর গভর্নর জেনারেল হলেন কুচক্রী আমরা গোলাম মোহাম্মদ। ১৯৫২ সালের গোড়ার দিকে ঢাকা শহরে সরকারি সফরে এসে নাজিমুদ্দিন জিন্নার কণ্ঠ অনুকরণ করে ঘোষণা করলেন, উর্দু’ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আবার শুরু হলো সংগ্রাম। বাংলাদেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট, ছাত্র-বিক্ষোভ। যার পরিণতি রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারী। এই তারিখে ঢাকার ছাত্রেরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সাবেক প্রাদ্রেশিক পরিষদ ভবনের কাছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। প্রথম দিনেই গুলিতে শহীদ হন বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ অসংখ্য ছাত্রও অন্যান্য পেশার লোক। সারা বাংলাদেশে পািকস্তানি প্রশাসন ভেঙে পড়ে।

২৬শে, ২৭শে ও ২ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে ছিল-সামরিক শাসন। শহীদের জন্য গায়েবি জানাজা, শোক মিছিলের উপরও সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছে। হাজার হাজার রাজবন্দীতে ভরে গেছে জেলখানা। হাসপাতালে আহতদের স্থান সংকুলান হয় নি। পুরো সাতদিনে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে উড়েছে শোকের কালো পতাকা। শেষ পর্যন্ত সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন, তাঁরা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পুনরায় বিচার বিবেচনা করবেন। প্রাদেশিক পরিষদে মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন নিজে প্রস্তাব তুললেন, বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা করার জন্য। তা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রথম সফল গণঅভ্যূত্থানের দিন। এই অভ্যূত্থানের মুখে পাকিস্তানি শাসকচক্র সাময়িক পশ্চাদপসরণের কৌশল গ্রহণ করলেন।

মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা যত হ্রাস পাচ্ছিল তারা ততই আমলাতন্ত্র ও সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। আমলাতন্ত্র ও সামরিক চক্র এক হয়ে এর সুযোগ নিলেন। সেনাপতি আইয়ুব খাঁর সমর্থন পেয়ে আমলা গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করে দিলেন। এবার ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বগুড়ার নবাবজাদা মোহাম্মদ আলী এলেন পুতুল প্রধানমন্ত্রী হয়ে।  (চলবে)

বি. দ্র. : লেখাটি ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস বার্ষিকী উপলক্ষে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ নামক স্মারকগ্রন্থ থেকে নেওয়া।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.