× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

মানবাধিকার ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী

হীরেন পণ্ডিত

১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:১৪ এএম

বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ প্রতিবন্ধী মানুষ। শুধু সমাজ বা রাষ্ট্র থেকেই নয়, এমনকি পরিবার থেকেও প্রায়শই বঞ্চনা আর নেতিবাচক আচরণের শিকার হন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে প্রতিবন্ধীদের রয়েছে নানা বঞ্চনা আর বৈষম্যের অভিজ্ঞতা। বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নিজের অধিকার আদায়ে প্রতিবন্ধীরা নানাভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সমতা বলতে বোঝায় মৌলিকভাবে ‘আমরা সবাই এক’, আমাদের নানা ধরনের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সবার জীবনের মূল্য একই। শুধু মানব সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়ার কারণেই মানবাধিকারের সব মানুষের রয়েছে সমান দাবি এবং অধিকার। মানব বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা মানুষের এ অধিকারকে স্বতন্ত্র করে তোলে কিন্তু তা কখনই ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। সমতার মূলনীতিসমূহ চর্চা করতে গেলে বা করার সময় ব্যক্তিসহ গোটা সমাজকে প্রতিবন্ধীতাসহ সব ধরনের মানব  বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।

সমতার মূলনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করা হয়। প্রথমেই যেটি নিয়ে আলোচনা করা হবে সেটিকে বলা হয় ‘আনুষ্ঠানিক সমতা’ এবং এটি সাধারণত ঘটে থাকে যখন কোনো আইন বা নীতিমালায় আহ্বান করা হয় যে, নানা স্তরের জনগণকে সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার জন্য বা কাউকে যেন বৈষম্য না করা। কিন্তু শুধু এর দ্বারা প্রতিবন্ধী বা যেকোনো জনগোষ্ঠীর জন্য সত্যিকারের সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, এটি যথেষ্টও নয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সমাজ দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম বাধাসমূহের সম্মুখীন হয়, সেগুলো বিবেচনা ও মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দরকার হতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম-সুযোগ দিতে হলে, কাঠামোগত-তথ্যগত, যোগাযোগের ক্ষেত্রে এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত যেসব বাধার সম্মুখীন হয়, সেগুলো নির্মূল করতে হবে। সমতা প্রতিষ্ঠায় আরেকটি যে পন্থা অবলম্বন করা হয়, সেটিকে প্রায় ক্ষেত্রেই বলা হয় ‘সুযোগের সমতা’। এ পন্থা স্বীকৃতি দেয় যে, মানুষ তার নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে কিছু বিষয় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়।


বর্ণ, লিঙ্গ, প্রতিন্ধিতা এবং সামাজিক অবস্থান। শুধু এ বিষয়গুলো অথবা এর সঙ্গে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিগত এবং অন্য বাধা যোগ হয়ে নিজেদের মতো করে জীবন যাপন করা এবং সমাজে অবদান রাখা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে হলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়, যা কিনা ‘আনুষ্ঠানিক সমতা’-র বাইরে এবং তা বিশেষভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদেরও একই সুযোগপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে। সেগুলো হতে পারে- পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন চর্চা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং প্রতিবন্ধিতার ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তৃতীয় যে পš’া অবলম্বন হিসেবে যেটি উল্লেখ করা হয়, সেটি হলো- ‘প্রকৃত বা কার্যত সমতা’।

এ পন্থার মূল বক্তব্য হলো- ‘শুধু সুযোগের সমতা নয় ফলাফল বা পরিণতির সমতাও নিশ্চিত করা’। মানুষের সমতা নিশ্চিত করার জন্য ‘সব মানুষ সমান’ শুধু এ বাক্যটি যথেষ্ট নয়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, প্রকৃত বা কার্যত সমতা মনে করে, ব্যক্তি সমাজে কতটুকু অবদান রাখতে পারল বা তার রাখার সামর্থ্য কতখানি রয়েছে তা নির্বিচারে সবারই রয়েছে মানবাধিকারসমূহে সমান ও সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার অধিকার। যদিও ‘সুযোগের সমতা’ পš’ার সঠিক প্রয়োগই যথেষ্ট, বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ যাতে তাদের মতো করে মানবাধিকার উপভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য, কিন্তু ‘প্রকৃত সমতা’ পš’ার ওপর বাড়তি অঙ্গীকার প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

বলা যেতে পারে যে, কাজ বা চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করলেই প্রতিবন্ধীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে না, যদি না একই সঙ্গে কাজ বা চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এ কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রকৃত সমতা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে প্রতিবন্ধীর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা চাকরির বাজারে অন্য সবার মতো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

 বৈষম্যকরণের মূল অর্থই হলো ‘ ভেদাভেদ করা, অবজ্ঞা করা, অবহেলা করা, নিম্ন  রেশ্রণির ভাবা, অবমাননাকর আচরণ করা’ এবং এর ভাব বা লয় সম্পূর্ণ নেতিবাচক। আচরণ বর্ণনার ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহারকালে সেটি আরও নেতিবাচক রূপ নেয়। যখন কোথাও উল্লেখ করা হয় কাউকে ‘বৈষম্য’ করা হয়েছে, তখন এর অর্থই হলো- ব্যক্তিটির সঙ্গে শুধু ভিন্ন আচরণই না অন্যায্য আচরণও করা হয়েছে।

এ ধরনের অন্যায্য আচরণ করা হতে পারে সুস্পষ্টভাবে, যেমন- এমন একটি আইন পাস হলো, যেটি খুব উন্মুক্তভাবে প্রতিবন্ধী মানুষকে বৈষম্য করে অথবা এটি হতে পারে খুবই অস্পষ্টভাবে। যেমন- আইনটি হয়তো নিরপেক্ষ, কিন্তু এর প্রয়োগ হয় প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিকূলে। এ ধরনের অস্পষ্ট বৈষম্য ক্ষতিকর হতে পারে কারণ, জনগণ মনে করতে পারে যে, সুস্পষ্ট বৈষম্য না থাকার অর্থই হলো সেটি ন্যায্য, এর প্রভাব ক্ষতিকর হলেও।


বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এর দ্বারা যে কৃতি হতে পারে তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে বিষয়গুলোকে আখ্যায়িত করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো কিছু, প্রতিবন্ধিতা, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, জাতিসত্তা ইত্যাদি অথবা অন্য যেকোনো কিছুর ভিত্তিতে কাউকে বৈষম্য করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণেই বৈষম্যহীনতার মূলনীতি হলো- কোনো ধরনের বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত না হওয়ার অঙ্গিকার এবং অস্পষ্ট ও পরোক্ষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া। রাষ্ট্রকেও নিশ্চিত করতে হবে সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে থাকবে তার অবস্থািন, সেটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের বৈষম্য হলেও।

বৈষম্যহীনতার সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর দিক হচ্ছে যে, রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনও হয়। এর কারণ হলো- বৈষম্যহীনতা ও সমতার মূল নীতিসমূহ একে অপরের সঙ্গে ক্রিয়াশীল। প্রতিবন্ধীর ওপর দীর্ঘমেয়াদি যে বৈষম্য করা হয়েছে, যা তাদেরকে অন্য সবার মতো সম্পূর্ণ সমতা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য করেছে।

এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে রাষ্ট্র কিছু পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা বিশ্বের নানা দেশে ও প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়। নানা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী কর্মীদের অবদানকে মূল্যায়ন ও আরও বেশি প্রতিবন্ধীকর্মী নিয়োগ দেয়ার জন্য উৎসাহিত করতে প্রচেষ্টা নিলে হয়তো নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কিছু বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ‘স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন সেবা প্রাপ্তির অধিকার’কে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির এ অধিকার লঙ্ঘিত হলে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার থেকেও সে বঞ্চিত হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিপূরক ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে আলাদাভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারসনদ প্রণীত হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ প্রতিবন্ধী মানুষ। শুধু সমাজ বা রাষ্ট্র থেকেই নয়, এমনকি পরিবার থেকেও প্রায়শই বঞ্চনা আর নেতিবাচক আচরণের শিকার হন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে প্রতিবন্ধীদের রয়েছে নানা বঞ্চনা আর বৈষম্যের অভিজ্ঞতা। বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নিজের অধিকার আদায়ে প্রতিবন্ধীরা নানাভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। দুনিয়াব্যাপী প্রতিবন্ধিতা আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন জাতিসংঘ প্রতিবন্ধীর অধিকার সনদ বা সিআরপিডি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানব বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের চিরন্তন মর্যাদার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এখানে প্রতিবন্ধীদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সমাজকে সবার জন্য উপযোগী করার মাধ্যমে সব সামাজিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। দুনিয়াব্যাপী প্রতিবন্ধিতা আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন এই সনদের এক গর্বিত ও অগ্রণী অংশীদার বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার অত্যন্ত প্রতিবন্ধীবান্ধব এবং প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছে। প্রতিবন্ধীরা সমাজের সব ক্ষেত্রে তাদের অধিকার ভোগ করতে পারছে। তবু সমাজের সবাইকে প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণে আরও কাজ করতে হবে এবং তাদের সম-অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

 লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি।


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.