× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

শিক্ষা ও ওমিক্রন

রঞ্জন মল্লিক

২০ জানুয়ারি ২০২২, ০৫:৪৬ এএম । আপডেটঃ ২০ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:৩৬ এএম

শিশুরা বিদ্যালয়ে যাবে, মনের আনন্দে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে খেলবে, গান গাইবে, ক্লাসের শুরুতে সমবেতভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাইবেÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবং জাতীয় পতাকাকে সম্মান দেখাবেÑ যা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। করোনাভাইরাস এসে ২০২০ সাল থেকে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল। টানা দেড় বছর তারা বিদ্যালয়মুখী হয়নি। তাদের আনন্দের জায়গাটা আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়েছিল।

২০২১ সালের মাঝামাঝি করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে এলে শিশুরা সপ্তাহে ১ বা ২ দিন করে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আতঙ্ক কমতে শুরু করে। পরিস্থিতি যখন একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে তখন আবারও করোনার ‘মামাতো ভাই’ ওমিক্রন এসে হানা দিতে শুরু করে। নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি হয় সবার মধ্যে। শিক্ষার্থীরা আবার বিপদের মুখে পড়ে।

কী এই ওমিক্রন? শিশুরা ওমিক্রন সম্পর্কে আর কোনো ধারণা নিতে চায় না। তারা মুক্ত বাতাসে বিচরণ করতে চায়। গত দেড় বছরে বাংলাদেশসহ বিশে^র প্রায় সব দেশের শিশুরাই বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় ছেদ পড়ে। দেড় বছর পর যখন স্কুল খুলল তখন শিশুদের কী উচ্ছ্বাস। রাজধানীর ছোট-বড় সব স্কুলেই সেদিন উৎসবের ভাব ছিল। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিশু শিক্ষার্থী বই-খাতা নিয়ে স্কুলে আসে। স্কুলের গেটে এসে আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়ে, এ যেন তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রাপ্তি। কী আনন্দ, সে যেন ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না। ছাত্রীটির আবেগ ও ভালোবাসা দেখে সাংবাদিকরাও সেদিন চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। এ যেন বিজয়ের কান্না। এ যেন বিনা বিচারে দীর্ঘদিন জেল খেটে অবশেষে মুক্তির আনন্দ। মুক্ত, স্বাধীন, চিরচেনা পরিবেশে আবারও ফিরে আসতে পেরেছে পাখিটি। এমনটা হবে না কেন? ঢাকা শহরে যারা বাস করেন তারা সবাই দেখেছেন কি বদ্ধ পরিবেশে মানুষ কাটিয়েছে দেড়টি বছর। অজানা আশঙ্কায় দিন গুনেছে মানুষ। আমি দুপুরে প্রায়ই ধানমন্ডি মিরপুর রাস্তায় হাঁটতে বের হতাম। বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট সব নীরব। যেন বোমারু বিমান এসে হামলা করবে কিছুক্ষণের মধ্যে। অথবা হরর ছবির প্রেতাত্মা এসে বুকের মধ্যে বসবে, ছিনিয়ে নিবে হৃৎপিণ্ড। সেই ভয়াবহ নীরবতা শিশুরা তো নয়ই, বড়রাও আর দেখতে চান না। বর্তমানে বিপদ যা-ই আসুক তার মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার অনেকটাই মোকাবিলা করছে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে।

বর্তমানে আবার ওমিক্রনের হামলা চলছে। কিš‘ সত্যিকার অর্থে  ওমিক্রন সম্পর্কে শিশু শিক্ষার্থীরা আর কোন ধারণা নিতে চায় না। শিশুরা চায় মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ। যে পরিবেশে সে অবাধে বিচরণ করতে পারবে, শিখতে পারবে, নতুন কিছু উপলব্ধি করতে পারবে। তারা চায় আনন্দ,উ”ছ¡াস ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। এই চাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর বড়রা এই স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করবে- এটাই মূল কথা।

২০২০ সালে করোনা মোকাবিলার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় শুরুতে আমরা অনেক পিছিয়ে ছিলাম। ২০২১ সালে তা অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়। টিকাদান শুরু হলে প্রথম টিকার স্বল্পতা ছিল, পাশাপাশি টিকা গ্রহণে অনেকের অনিহা ও ছিল। ফলে স্বাভাবিক হতে একটু সময় বেশি লাগে। বর্তমানে মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণে অনিহার কারণ নেই বললেই চলে, তবে ডেলটা ভেরিয়েন্টের প্রতাপ রুখতে সমাজ অনেক সচেতন হয়েছে। ২০২২ সালে এসে আমরা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। আমাদের একদিকে যেমন আছে করনা ব্যবস্থাপনার দুই বছরের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে শিক্ষার্থীসহ  জনগনের বড় একটি অংশ ইতিমধ্যে টিকার আওতায় এসেছে।

বর্তমানে সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা হলো টিকার বড় ধরনের মজুত আছে। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখন আর কোন অনিশ্চয়তা নেই। এখন দরকার সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা। আর এ জন্য বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা থাকার কথা নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিতান্ত প্রশংসার দাবিদার। শিশুদের বিদ্যালয়ে আসার বা বিদ্যালয় খোলা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত রাখতে হবে। নইলে শিশুরা যে বিরতির মধ্যে পড়েছে তা থেকে উতরে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভঙ্গুর জাতিতে পরিণত হবে।

আমাদের দেশ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শিক্ষার মানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের সব জেলায় বা থানায় বা গ্রামগঞ্জে  শিক্ষার মান এক রকম নয়। কোথাও শিক্ষার মান ভালো তাই সেখানকার শিক্ষার্থীরা দক্ষ হয়ে উঠছে। শিক্ষার মান মূলত নির্ভর করে শিক্ষক ও শিক্ষা পদ্ধতির ওপর। এর ব্যতিক্রম হলে মান ধরে রাখা কষ্টকর। শিশুর মেধার বিকাশ ঘাটায়- শিক্ষক ও শিক্ষা পদ্ধতি। এই বিষয়গুলো সর্বত্র সঠিক ভাবে মানা হচ্ছে কি? পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করতে পারবেন। শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ই যদি ফাঁকি দেয় তবে সুশিক্ষা বা সুষম শিক্ষার ইজ্জ্বত নষ্ট হয়। আমাদের সমাজে আমরা এসব অসঙ্গতি অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করছি। এর ওপর নতুন উপসর্গ হলো করোনাভাইরাস। করনা মহামারিতে শিশুরা বাধ্য হয়ে ঘরে থেকেছে প্রায় দেড় বছর। একে তো শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তার ওপর করনা মহামারি। ফলে শিশুর শৈশব ও শিক্ষা অনেকটা চুলোয় উঠেছে।

আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ বড় বড় শহরের অভিভাবকদের মতো শিক্ষা খাতে তেমন ব্যয় করে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ শুধু সরকার করবে না অভিভাবকরাও করবেন, এই বোধ অনেক অভিভাবকের মধ্যে নেই। কারণ অর্থনৈতিক টানাপড়েনে স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা শিক্ষায় বিনিয়োগ এই শব্দের সঙ্গে তেমন পরিচিত নন এবং এটাই স্বাভাবিক। এই স্বল্প আয়ের অভিভাবকদের সংখ্যা যে দেশে বেশি সে দেশে শিক্ষায় বৈষম্য থাকবে - এটা সরকারের দোষ নয়, পুঁজিবাদের নিয়ম। ২০২০ এ করনার আক্রমণ বিষয়টিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেদ পড়লে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী অর্থাৎ দেশের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। কারণ এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা স্বল্প বা মধ্যম আয়ের, তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। দেশের ৯০ শতাংশ শিশুকে টেনে তোলা আদৌ কি কারো পক্ষে সম্ভব? স্কুলে না আসতে পারলে কোমলমতি শিশুরা বিভ্রান্ত হবে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটবে। তারা অলস, নির্জিব বা বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

তাই প্রজন্ম রক্ষায় করনা ভাইরাস বা অভিক্রমের মধ্যেই চলতে হবে আমাদের। এই ভাইরাস যদি আগামী ১০ বছরের মধ্যে না যায় বা একে দমন করা না যায়- তবে কি এভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। শিশুরা একদিন বা দুই দিন স্কুলে যাবে এবং শট সিলেবাসে পরীক্ষা দিবে-এটা কত দিন চলবে? প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে হলে প্রতিদিন শিশুরা স্কুলে যাবে, তাদের প্রতিদিন একটু একটু করে দক্ষতা বাড়বে - তারা দেশের ভবিষ্যত যোদ্ধা হবে। কিš‘ তাদের বেড়ে ওঠা যদি সুষম না হয়, তবে কিভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে এবং দেশকে কিভাবে নেতৃত্ব দেবে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে এখনই চিন্তাবিদদের ভাবা উচিত। শিশুরা দেখে শিখে, খেলায় শিখে, ক্লাসে বসে শিখে, খেলাধুলায় শিখে, দশ জনের সাথে মেলামেশা করে শেখে-এ স্বাভাবিক শিক্ষা থেকে দু’বছর ধরে বঞ্চিত তারা।  এখন তারা মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এই আসক্তি ধনী, গরীব সব পরিবারেই দেখা দিয়েছে। পিতা-মাতা নিরুপায় হয়ে তাদের ছেলে মেয়েদের সর্বনাশ চোখের সামনে দেখছে, যেন সত্যিকার অর্থে বলার কিছুই নেই। শিশুরা যে খাবার গ্রহণ করে তার ক্ষয় সে কিভাবে করবে, যদি না হাঁটে, যদি না দৌড়ায়, যদি স্কুল প্রাঙ্গণে না যায় তবে এই শক্তি ব্যয় করবে কোথায়? চোখের সামনে শিশুরা যেন সর্বনাশা মাদক নিচ্ছে, বাবা-মা তাদের দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করছে-  এর চেয়ে কষ্টের কি হতে পারে।   

করনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত দুই বছরে প্রাক-প্রাথমিক অর্থাৎ প্লে-গ্রুপ ও নার্সারি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তো শিক্ষা জীবন শুরু করতেই পারেনি। জাতীয় ভাবে এই ক্ষতির হিসাব নিকাশ করা না হলেও আমাদে যাদের ঘরে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী আছে, তাদের কাছে ক্ষতির অংশটা সহজেই বোধগম্য।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে এখন যতটুকু খেলা আছে, তা-ও যদি আবার বন্ধ হয়ে যায়, নামসর্বস্ব যতটুকু শিক্ষা চালু আছে, সেটাও আবার অনিশ্চয়তার অন্ধকারে পতিত হবে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশে^র দেশে উন্নিত করতে চায়। কিš‘ তা কি আদৌ সম্ভব। সম্ভব তখনই হবে, সরকার যদি দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারেন। উন্নত দেশের রুপকল্প বা ভিশন ২০৪১,  দক্ষ জনবল ছাড়া কি সম্ভব?  আজকের শিক্ষার্থীরাই রুপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মূল কর্ণধার।  এই শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয় প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রধান শর্ত হলো শত বিপদের মধ্যেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা। মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় গ্রেট ব্রিটেন শিশুদের জন্য দুধের সরবরাহ চালু রাখে এবং জার্মানির শত বিমান ওমিক্রনের মধ্যেও অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখেছিল। পাশাপাশি বিনোদনের জন্য সিলেমা হল ও থিয়েটার হলগুলো একদিনের জন্যও বন্ধ রাখেনি। তাই সর্বাগ্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা সরকার ও জনগণ মনে রাখবেন, শিক্ষার্থীরা যেন করোনার কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষার সকল প্রতিষ্ঠান খোলা রবে- এই অঙ্গীকার হোক আমাদের। জয় বাংলা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.