× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়ছি

আলী আদনান

২১ মার্চ ২০২২, ১২:৩১ পিএম

জোনায়েদ সাকি

জোনায়েদ সাকি। বাংলাদেশের অন্যতম একজন রাজনীতিবিদ। গণসংহতি আন্দোলন- এর প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ২০০২ সালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই। সরকার বিরোধী প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন দাবি নিয়ে তার গোছানো আলোচনা বেশ জনপ্রিয়। বিরোধী দলের রাজনীতিতে সমসাময়িক সময়ে তিনি অন্যতম পরিচিত মুখ। টেলিভিশন টকশোতে সমসাময়িক রাজনীতির  নানা দিক নিয়ে কথা বলেন প্রায় সময়। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় গণসংহতি আন্দোলনের হাতিরপুলস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলাপ হলো এই রাজনীতিবিদের সাথে।

যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম কয়েকদিন ধরেই। কিন্তু তার ব্যস্ততার কারণে আমাদের দু'জনের সময় ও সুযোগ দুটো ঠিক সমান তালে মিলে উঠছিল না। অবশেষে ঠিক হলো, বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যা ঠিক আটটায় গণসংহতির অফিসে একসাথে কফি খাব।

তার চোখে মুখে ক্লান্তি। মাঝে মাঝে ফোন আসছে। তিনি সবকিছু এড়িয়ে বললেন, শুরু করুন। নয়তো আবার কখন সুযোগ করতে পারি তার নিশ্চয়তা নেই।

আলোচনার প্রথমেই জিজ্ঞেশ করলাম, গণসংহতি আন্দোলন এই মুহূর্তে ঠিক কোন বিষয়টাকে প্রধান এজেন্ডা ভাবছে?

অনেকটা শান্ত কণ্ঠেই শুরু করলেন তিনি। বললেন, আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়ছি। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, এখানে ক্ষমতার জবাবদিহিতা থাকবে। ভারসাম্য থাকবে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো এমন জায়গায় থাকবে, যাতে কোন দল ক্ষমতায় গিয়েও পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে নিজেদের পকেটে নিতে পারবে না। জনগণ যখন কোন দলকে  ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে তাহলে সেই দল সরকার গঠন করে সরকারের মতো পরিচালনা করবে। পাঁচ বছরের শাসনের মধ্যে যদি দেখা যায় তারা জনগণের আস্থা আর রাখতে পারছে না তাহলে জনগণ আবার ভোট দিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিতে পারবে। অন্য কাউকে তারা ক্ষমতায় পাঠাতে পারবে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা বিভিন্ন দেশে চালু আছে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা বাংলাদেশে তৈরী করা দরকার এবং একে আরো শক্তিশালী করা দরকার। এমন জবাবদিহিতার জায়গা নিশ্চিত হওয়া দরকার যাতে সরকারগুলো জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য হয়। তারা সত্যিকার অর্থে তাদের ওয়াদা পূরণ করছে কিনা তাও যেন জনগণ নিশ্চিত হতে পারেন। দেশে রাজনৈতিক সংকটটা দূর করাটাই হচ্ছে জনগণের অধিকারের দিক থেকে একটা প্রধান কাজ এবং বাংলাদেশকে আজকে বৈশ্বিক বাস্তবতায় সার্বভৌম মর্যাদা সহ নিজেদের ভবিষ্যৎটাকে রচনা করার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী।

তার কথা টেনে নিয়েই বললাম, কিন্তু দেশে তো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই কার্যকর আছে।

তিনি বললেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার গঠিত হবে। এবং তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। সরকার যারা নির্বাচন করবে অর্থাৎ জনগণ- সরকার কখনোই জনগণকে ছাপিয়ে যাবে না। তার উপর প্রভুত্ব করতে পারবে না। জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকারের মৌলিক জায়গা। আমি যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাবি করি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যটাই হচ্ছে, জনগণ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার গঠন করবেন। ফলে কে ক্ষমতায় যাবে এটা তো আসলে জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। কিন্তু জনগণ যখন ভোটই দিতে পারছেন না তখন কিন্তু ভোটের লড়াইটা হচ্ছে প্রধান লড়াই। আমরা কিন্তু একজনের ভোটের জন্য লড়াই করছি না। আমরা প্রত্যেকটি নাগরিকের ভোটের জন্য লড়াই করছি। ভোট প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। সেদিক থেকে দল নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের ভোট এখন বিপদগ্রস্থ৷

শান্ত কিন্তু জোরালো কন্ঠে অনেকটা চাপ দিয়ে জোনায়েদ সাকি বললেন, এই সরকার ভোটাধিকার হরণ করে দেশের সকল নাগরিককে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমনকি যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারাও ভোট দিতে পারেন না।  এই সার্বজনীন লড়াইটাকে যদি আমরা সংগঠিত করতে পারি সার্বজনীন ভাবে তাহলে আমরা আমাদের ভোটাধিকার ফিরে পাব। ভোটাধিকারটাকে স্থায়ী করতে গেলে একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জায়গায় আমাদের যেতে হবে। ফলে আজকের লড়াইটা হচ্ছে ভোটাধিকার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে এ সরকার পতনের লড়াই।

বললাম, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো শক্তিশালী ভাবে সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারেনি। এটা কী সরকারের দায় নাকি বিরোধী দলের ব্যর্থতা?

উত্তরে জোনায়েদ সাকি বললেন, ২০১৪ সালে এমন একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচনের আগেই নির্বাচিত হয়ে গেলেন এবং সরকার গঠনের জন্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার তা তারা নির্বাচনের আগেই নিশ্চিত করলেন। এবং এটাকে গণতান্ত্রিক বলে তারা পাঁচ বছর শাসন করলেন৷ তারপরে যখন বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করলো এবং তাদের দাবি দাওয়া উথাপন করলো সরকার তাদের সাথে সংলাপে বসেছে। কিন্তু সেই সংলাপের মধ্য দিয়েও একটা সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপর ভরসা রাখার জন্য ওয়াদা করা সত্ত্বেও আমরা দেখলাম পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে আগের রাতে কীভাবে ব্যালটবাক্স ভরে একটা প্রহসন ও তামাসার ভয়াবহ নির্বাচন আমাদের  এখানে প্রতিষ্ঠিত করলো। এবং সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে এখনো ক্ষমতায় আছে। ক্ষোভ ঝরা কণ্ঠে তরুণ এই রাজনীতিবিদ দাবি করেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো এতো ব্যাপকভাবে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি।

সাকি বললেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন- যে নির্বাচনে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল কিন্তু সেই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট ডাকাতি হয়েছে। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এমন একটি নির্বাচনে এরকম ভোটডাকাতি এর আগে বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। সেদিক থেকে এটি সবচেয়ে নিকৃষ্টতম একটি নির্বাচন৷ এরকম পরিস্থিতি - বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নাই করে দেওয়ার ফলে এখানে সমাজের মধ্যে বিভাজন এবং নানা ধরনের নৈরাজ্য এটাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের যে অস্তিত্ব তাকেও নানা ধরনের হমকির মধ্যে ফেলা হয়েছে।

আমি জানতে চাইলাম, আপনারা বর্তমান সরকারের পতন চাচ্ছেন। কিন্তু অন্য অনেক সরকারের তুলনায় কী বর্তমান সরকার ভালো নয়?

সাকি হয়তো এ প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোটা সংবিধানে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল- এখানে মৌলিক জায়গার লংঘন করা হয়েছে। যারাই জনগণ দ্বারা একবার নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন তাদের মধ্যে এমনভাবে ঘটছে যে তারা জনগণের প্রভুত্ব করার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে সমস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপরে তারা এমনভাবে তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করছেন যার মধ্য দিয়ে অন্যদের অধিকার পুরোপুরি হরণ করা সম্ভব হয়। এর ফলে এমন একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়, যার ফলে বিচার ব্যবস্থা আস্থার জায়গায় থাকে না। নির্বাচন ব্যবস্থা আস্থার জায়গায় থাকে না এবং মানুষের অধিকারগুলো আর কার্যকর থাকে না।

জোনায়েদ সাকি বলেন, গণতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন৷ কিন্তু গণতন্ত্রের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সংখ্যালঘিষ্ঠ যারা তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচারে রূপান্তরিত হতে না পারে, সেজন্য সংখ্যালঘিষ্ঠ যারা তাদের অধিকারের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তাই হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর আছে কিনা তার প্রমাণ।

কিন্তু এর আগে বিভিন্ন সময়ে যারা ক্ষমতায় ছিল তারাও একই ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। এমন ইঙ্গিতে জোনায়েদ সাকি বললেন, বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোটা সংবিধানে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল- এখানে মৌলিক জায়গার লংঘন করা হয়েছে। যারাই জনগণ দ্বারা একবার নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন তাদের মধ্যে এমনভাবে ঘটছে যে তারা জনগণের প্রভুত্ব করার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে সমস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপরে তারা এমনভাবে তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করছেন যার মধ্য দিয়ে অন্যদের অধিকার পুরোপুরি হরণ করা সম্ভব হয়। এর ফলে এমন একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়, যার ফলে বিচার ব্যবস্থা আস্থার জায়গায় থাকে না। নির্বাচন ব্যবস্থা আস্থার জায়গায় থাকে না৷ এবং মানুষের অধিকারগুলো আর কার্যকর থাকে না।

তিনি বলেন, জনগণ যখন কোন দলকে  ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে তাহলে সেই দল সরকার গঠন করে সরকারের মতো পরিচালনা করবে। পাঁচ বছরের শাসনের মধ্যে যদি দেখা যায় তারা জনগণের আস্থা আর রাখতে পারছে না তাহলে জনগণ আবার ভোট দিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিতে পারবে। অন্য কাউকে তারা ক্ষমতায় পাঠাতে পারবে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা বিভিন্ন দেশে চালু আছে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা বাংলাদেশে তৈরী করা দরকার এবং একে আরো শক্তিশালী করা দরকার। এমন জবাবদিহিতার জায়গা নিশ্চিত হওয়া দরকার যাতে সরকারগুলো জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য হয়। তারা সত্যিকার অর্থে তাদের ওয়াদা পূরণ করছে কিনা তাও যেন জনগণ নিশ্চিত হতে পারেন।

বর্তমানে কোন রাজনৈতিক দলকেই সংগঠিত ভাবে রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। এটা কী তাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতা নাকি জনবিচ্ছিন্নতা এমন প্রশ্নের জবাবে জোনায়েদ সাকি বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা নাই হয়ে গেছে। এই নাই হয়ে যাওয়ার জন্য প্রধান দায়ী সরকার। দেশে বিরোধী দলগুলো স্বাভাবিক রাজনীতির গতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর যে অসংগঠিত অবস্থা, তাদের যদি কোন দুর্বল জায়গার কথা বলেন- দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা এখন এমন, এখানে বিরোদী দলগুলো এখন প্রবল নিপীড়নের মুখে আছে। এখানে বিরোধীদলগুলোকে তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফাংশান করতেই দেওয়া হচ্ছে না। বিরোধীদলগুলো যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফাংশান করতে না পারে তাহলে কীভাবে তারা সংগঠিত রূপ নিবে এবং কীভাবে তারা একটা শক্তিশালী চেহারায় থাকবে। তিনি বলেন, বিরোধী দলগুলো দুর্বল হওয়ার জন্য বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার ব্যবস্থা দায়ী। আমাদের এখানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা নাই হয়ে যাওয়ার পেছনে যেমন একটা ধারাবাহিকতা আছে তেমনি বিশেষভাবে বর্তমান সরকার একে এখন চূড়ান্তে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ সাংবিধানিক ক্ষমতার যে ভিত্তিটা তার স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠার পেছনে প্রত্যেকটা সরকারেরই দায় আছে। কিন্তু বর্তমান সরকার এই সাংবিধানিক স্বৈরাচারী ক্ষমতার কাঠামোকে ব্যবহার করে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে যেভাবে দলীয়কৃত করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যেভাবে তারা পুরো দেশের মধ্যে একটা বিভাজন সৃষ্টি করেছে, নিজেদের শাসনটাকে বৈধতায় রূপ দিচ্ছে- সেটাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নাই করে দেওয়ার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

বললাম, কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারাও বেশ নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তারা কিন্তু দমে যায়নি বরং বিরোধী দল হিসেবে বেশ সফল ছিল। এখনকার বিরোধী দলগুলো কিন্তু সেটা পারছে না।

উত্তরে জোনায়েদ সাকি বললেন, হ্যাঁ বর্তমানে যারা সরকারে আছে তারাও একসময় বিরোধী দলে ছিল। তারাও তখন গণতন্ত্রের কথা বলেছে। ভোটের কথা বলেছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলেছে। তারাও বিরোধী দলে থাকার সময় বিভিন্ন ধরনের মামলা হামলার শিকার হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে তারা একটা শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করবেন, সকলের অধিকার নিশ্চিত করবেন - সেই পথে হাঁটেননি। বরং যে স্বৈরাচারী শাসনের কবলে তারা পড়েছিলেন সেই স্বৈরাচারী শাসনকেই কেবল তারা অনুসরণ করেছেন তা না বরং সেই স্বৈরাচারী শাসনকে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়ে এমন এক প্রবল রূপে দাঁড় করিয়েছেন যা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে জোনায়েদ সাকি বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনকে গণতান্ত্রিক মোড়ক দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের একটা সাফল্য আছে। অর্থাৎ একটা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক মোড়ক নিয়ে, দমন পীড়ন চালিয়ে, ভয় দেখিয়ে তারা শোষণটা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শাসন বলছেন। কিন্তু মানুষকে আপনি কিছুদিন ভুল বুঝিয়ে রাখতে পারেন। চিরকাল ভুল বুঝিয়ে রাখতে পারেন না। ক্রমাগত মানুষ প্রতিদিন তার প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছে এই শাসনটা তাদের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

চা দেওয়া হয়েছে। তিনি চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন। বললাম, আপনি বলছেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা নাই হয়ে গেছে। এই যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নাই হয়ে যাওয়া- এর ফলাফল কী হতে পারে? একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে কী মনে করছেন?

জোনায়েদ সাকি বললেন, একটা দেশে যখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নাই হয়ে যায় তখন নানা ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সামাজিক ভাবে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হতে থাকে। এর ফলে এমন ধরনের সংকট তৈরি হয় যাতে সমাজের মধ্যে নাগরিকরা নানা ভাবে বিভক্ত হতে থাকে। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। কিন্তু এই যে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা বা নাগরিকদের মধ্যে বিভক্তি যাই বলিনা কেন- বিভক্তির ফলে সেই ঐক্যবদ্ধ রাখার জায়গাটা ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে। বিভক্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের যে ন্যায্যতা, জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া, সেই জায়গাটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে রাষ্ট্রের টিকে থাকার শর্তই ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে। ফলে, আমাদের এখানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নাই হয়ে যাওয়াটা আমাদের সামনে একটা বড় বিপদ। সেজন্য আমরা মনে করি যেকোন মূল্যেই আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে হবে। এবং এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সন্দেহাতীত ভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রক্রিয়া।

জানতে চাইলাম, গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রক্রিয়া ফিরে আসার উপায় কী? অন্য কোন শক্তিশালী ও জনসম্পৃক্ত সংগঠন তো এখানে নেই।

জোনায়েদ সাকি বললেন, দেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনতে হলে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সংস্কার প্রয়োজন। এই সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে সমস্ত ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে নিহিত হয় এবং সেই ব্যক্তি বা সেই দলীয় প্রধান পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রটাকেই এককভাবে দলীয়কৃত করে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। আমরা (গণসংহতি আন্দোলন) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য লড়ছি। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এখানে ক্ষমতার জবাবদিহিতা থাকবে। ভারসাম্য থাকবে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো এমন জায়গায় থাকবে, ফলে কোন দল ক্ষমতায় গিয়েও পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে নিজেদের পকেটে নিতে পারবে না।

জোনায়েদ সাকি বলে চলেছেন, সেজন্য কতোগুলো সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক সংস্কার দরকার। অর্থাৎ যে স্বৈরাচারী কাঠামোটা সাংবিধানিক ভাবে তৈরী হয়ে আছে সেটার এমন অনেকগুলো বদল আনতে হবে যে বদলের মধ্য দিয়ে আমরা জবাবদিহিতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেতে পারব। যেখানে কোন সরকারই আর পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাকে নিজের পকেটস্থ করতে পারবে না। সেখানে একটা জবাবদিহিতার জায়গা থাকবে। সেক্ষেত্রে আমরা ( গণসংহতি আন্দোলন) কতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলেছি। যেমন আমরা বলেছি, উচ্চ আদালত সহ নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। এবং এই সাংবিধানিক কমিশনই এই নিয়োগের প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করবে। সকল নাগরিকের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থায় যেতে হবে। যেখানে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থাও থাকবে এবং মোট প্রাপ্ত ভোটের অধীনেও সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারবে। তৃতীয়ত, যারা সংসদে নির্বাচিত হবেন তারা যেন জনগণের পক্ষে অর্থাৎ যে জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছে তাদের পক্ষে তিনি যেন সংসদে মতামত দিতে পারেন সেজন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করতে হবে।

সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জোনায়েদ সাকি আরো বলেন, আমরা মনে করি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে এমনভাবে ক্ষমতায়ন করতে হবে যাতে করে সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকান্ড স্থানীয় সরকারের হাত দিয়ে পরিচালিত হয়। সংসদ সদস্যরা প্রধানত আইন তৈরীর কাজে নিয়োজিত থাকবেন। দেশের ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে আরো বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থা এবং সংসদে একটি উচ্চকক্ষ - এ বিষয়ে একটি জাতীয় ঐক্যমত তৈরী করা দরকার।

তিনি বললেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে সকল আইনগুলো ঔপনিবেশিক আমল থেকে এখন পর্যন্ত বহাল আছে এবং মানুষের অধিকার হরণ করে এমন যেসব আইন আছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতাহীন করে ফেলে, তাদেরকে যথেচ্ছাচার কায়েম করতে সাহায্য করে- এরকম আইনগুলো বাতিল করতে হবে। আইন এমন ভাবে করতে হবে যাতে করে জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটা জবাবদিহিতার মধ্যে রাখে। শুধু মতপ্রকাশের আইন বা এ ধরনের জননিরাপত্তার আইন নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এমন আইনের আওতায় আনা দরকার যাতে করে এখানে জবাবদিহিতার জায়গাটা প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্নীতি যেখানে একটা সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে তার লাগাম টেনে ধরা যায়। এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো আমরা করছি।

আরো দু'কাপ চা এসেছে রুমে। একটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে তিনি বললেন, এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো কোন বিশেষ দলের জন্য নয় বরং এ ধরনের সংস্কারের ভেতর দিয়ে দেশের শাসন ক্ষমতায় যারাই যাক না কেন, ক্ষমতায় একটা জবাবদিহিতার সৃষ্টি হবে। যারাই ক্ষমতায় যাক না কেন তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ পরিচালনা করবে। কেউ আর পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে সরকারের সাথে একাকার করে ফেলতে পারবেন না। দলের সাথে একাকার করে ফেলতে পারবেন না। ফলে ক্ষমতার একটা ভারসাম্য থাকবে। 

তিনি বললেন, ভারসাম্য ছাড়া এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে না এমনটি দাবি করে জোনায়েদ সাকি বলেন, জনগণের যে অধিকার, তার যে সংকটগুলো, তার জীবনে যে বিরাট বৈষম্য- তার শিক্ষা নাই, স্বাস্থ্য নাই, তার নূন্যতম আয়ের নিশ্চয়তা নাই, তার কর্মসংস্থান নাই, দেশে শিল্প, কৃষির উন্নতিসহ সামগ্রীক ভাবে মানুষের যে কল্যাণ এই কর্মসূচীগুলো নিয়ে যে রাজনৈতিকদলগুলো মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করবেন এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকার গঠনের চেষ্টা করবেন, সংসদে প্রতিনিধিত্বের চেষ্টা করবেন, এবং এর মধ্য দিয়ে তারা জনগণের কল্যানে কাজ করবেন- সেই সুযোগটা একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হলেই কেবল জনগণের ভেতর থেকে তার যে প্রয়োজন, তার যে দাবিগুলো সেগুলো আরো সামনে আসতে পারবে। তার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সেসব জিনিসগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।

রাত বাড়ছে। পাশের রুম থেকে কেউ একজন ইঙ্গিত দিল জরুরী কথা আছে। তিনি ইশারায় তাকে যেতে বলে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। বললেন,  বৈশ্বিক বাস্তবতায় আমরা আছি সে বৈশ্বিক বাস্তবতার মধ্যে এখানে নানা ধরনের সংকট আছে। বিশ্বশক্তি এ অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতায় লিপ্ত। এরকম একটা পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে দেশের মধ্যে জনগণের ঐক্য, একটা জাতীয় ঐক্য খুব দরকার।

প্রশ্ন করলাম, আপনি বারবার জাতীয় ঐক্যমতের কথা বলছেন। ঐক্যমত বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছেন?

সাকি বললেন, 'জাতীয় ঐক্য' মানে এই নয় যে, সবাই একদল করবেন বা একই মতে চলবেন। জাতীয় ঐক্য মানে হচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকবে, তাদের মতামতেরও পার্থক্য থাকবে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীতাও থাকবে কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা এমন হবে যেটার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ থাকবে। জনগণকে জয় করে একটা দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠণ করবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এর ফলে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে যে সকল দলগুলো ক্ষমতা থেকে বিচ্যৃত হচ্ছে কিংবা ক্ষমতায় যেতে পারছে না, তারাও জাতীয় স্বার্থে সকলে নূন্যতম একটা জায়গায় থাকবে। এরকম একটা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের একটা শক্ত ভিত্তি দিতে সাহায্য করে। সেই জায়গাটা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে আমরা আন্তর্জাতিক ভাবেও হুমকির মধ্যে আছি।

তাছাড়া, যে দেশে মানুষের ভোটাধিকার থাকে না সে দেশে তো মানুষের নূন্যতম নিরাপত্তাও থাকে না। এখন তো মানুষের চিন্তা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতাই নাই।

কিন্তু সরকার উন্নয়নের জন্য প্রচুর বরাদ্দ করছে এমন ইঙ্গিতে জোনায়েদ সাকি বললেন, উন্নয়নের নামে সরকার ছোট, মাঝারি, বড় সহ নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করছেন। এই প্রকল্পগুলোতে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে তার নূন্যতম কোন জবাবদিহিতা নেই।  দেশের প্রকৃতি ও অগ্রগতিতে এই প্রকল্পগুলো প্রাধান্য পাবে কিনা তারও কোন বিচার বিবেচনা নেই। এই সমস্ত জায়গায় একটা স্বেচ্ছাচার চলছে। জনগণের সম্পদ লুট করা হচ্ছে এবং সেগুলো বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বিভিন্ন রকম গোষ্ঠী ক্ষমতার সাথে যুক্ত থেকে একটা স্বেচ্ছাচারীতন্ত্র কায়েম করেছে। এই স্বেচ্ছাচারীতার ভেতর দিয়ে তারা নানা ভাবে জনগণের পকেট হাতিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করছে।

জানতে চাইলাম, ঠিক এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতিতে কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রাধান্য দিতে চাচ্ছেন? ক্ষমতার পরিবর্তন নাকি ক্ষমতাসীন সরকারকে কিছু দাবি দিয়ে সেই দাবি আদায় করে নেওয়া?

জোনায়েদ সাকি তার স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন, ১৯৭২ সালে যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হয়েছিল সে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেশকে ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারছে না। বরং সেটা জনগণের মাঝে বিভাজন তৈরী করছে এবং দেশকে ও রাষ্ট্রকে হুমকির মুখে ফেলছে। জনগণের অধিকার হরণ করছে। কাজেই নতুন একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দরকার। যেটা করতে গেলে আমাদের প্রথম কথা হচ্ছে একটা সুষ্ঠ, গ্রহণযোগ্য, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা সরকার গঠণের জায়গায় যেতে হবে। এবং তা করতে গেলে বর্তমান সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠ নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করি না। তাই এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। পদত্যাগ করে একটা অন্তর্বতীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজের পরিধি নিয়ে সাকি বলেন, এই অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজ হবে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করে, জবাবদিহিতাপূর্ণ করে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অর্থাৎ একটা স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যমত তৈরি করা।

আমার পাল্টা প্রশ্ন, কিন্তু আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি,  ইয়াজ উদ্দিন সাহেবের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত ছিল। আপনার কথিত অন্তর্বর্তীকালীন কালীন সরকারেও যে দলীয় প্রভাবের ছায়া পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী?

মাথার চুল পেছনে দিকে আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে সাকি বললেন, নানা ধারাবাহিক সরকারের উথান পতনের ভেতর দিয়ে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেখেছিলাম। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত দলীয়কৃত হয়ে পড়েছিল। কারণ, ঐ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করা জবাবদিহিতার আওতায় আনার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ক্ষোভ ঝরা কণ্ঠে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংকটে পড়ার পরে তাকে সংস্কার না করে বা তার অপূর্ণতা দূর করার জন্য যা করার দরকার ছিল তা না করে তাকে বাদই দিয়ে দেওয়া হলো এবং আগের অবস্থায় চলে যাওয়া হলো এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যাপকভাবে দলীয়কৃত করে একটা ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশে এক নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদ চালু করা হয়েছে।

জানতে চাইলাম, আপনাদের সরকার বিরোধী এমন রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি উৎসাহিত হচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?

জোনায়েদ সাকি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কোন অস্পষ্ট ব্যাপার নয়। স্বাধীনতার ঘোষণা এটা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জায়গা যদি দেখেন তাহলে সেখান থেকেই আমার প্রশ্ন হলো, দেশের আঠারো কোটি মানুষের জন্য কী সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সাম্যকে যদি আমি নূন্যতম জায়গা থেকে দেখি, সকলের জন্য সুযোগের সমতা, সেটা কী তৈরি হয়েছে? নাকি প্রবলভাবে যারা ক্ষমতাবান সবকিছু তাদের দখলে চলে গেছে? দেশের আঠারো কোটি মানুষের জন্য মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। অর্থাৎ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষো সকলে তার নাগরিক অধিকার বুঝে পাওয়ার কথা। সেটা কী পেয়েছে? তা তো হয়নি উপরন্তু প্রবলভাবে এখানে নানা বৈষম্য বিরাজমান। সবশেষে এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে মানুষের ভোটের অধিকারটুকুও নেই। তৃতীয়ত হচ্ছে সামাজিক ন্যায় বিচার। দুই অর্থে সামাজিক ন্যায়বিচার কে বুঝতে হবে। বাংলাদেশে ন্যায়বিচার না পাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ এখন আছে। বিচার বিভাগকে যদি সরকার প্রভাবিত করতে পারে সেখানে মানুষের অধিকার থাকে না। যা এখন নেই। সামাজিক ন্যায়বিচার যদি অর্থনৈতিক ভাবে দেখি তাহলে সেখানে কতো কম বৈষম্য থাকবে সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু এখানে এখন উল্টো চিত্র। যারা সম্পদ সৃষ্টি করেন তারা সবচেয়ে নাজেহালের শিকার। এই যে নানা ভাবে তাদের নিগৃহীত অবস্থা,  এটা কমানোর কোন উদ্যোগ কী আছে? আমরা কমানোর কোন উদ্যোগ তো দেখছিই না। বরং যারা এখানে ক্ষমতাবান তারাই এখানে সম্পদের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে। তারা ব্যাংকের মালিক হন, ব্যাংক লোপাট করতে পারেন। তারা ব্যাংকে জমিদারী কায়েম করতে পারেন৷ সেভাবেই আইন তৈরী করা হয়। তারা সম্পদ লুট করে দেশ থেকে পাচার করে যাচ্ছে। তার জন্যও কোন নূন্যতম জবাবদিহিতা তৈরি হয়না। তাহলে যারা আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছেন তাদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতোটুকু নিরাপদ? বরং তাদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সবচেয়ে বড় অবমাননা হয়েছে। বরং আমরা দেখছি , বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে হাঁটছে।

বললাম, 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' এই কৌশলের জায়গা থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকার বিরোধী প্রত্যেকটি কর্মসূচীতে জামাত- শিবির রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। এটা কী আপনি অস্বীকার করবেন?

সাকির উত্তর, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী সহ আরো তিনটি দল রাজনৈতিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যাকে সমর্থন করেছে এবং তারা সহযোগী সংগঠন তৈরী করে এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন এখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় তখন এখানেও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো আর ক্রিয়াশীল থাকতে পারে না। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র পত্তনের মধ্য দিয়েই জামাত নামে কোন সংগঠনের রাজনীতি আর ক্রিয়াশীল থাকতে পারে না। অর্থাৎ এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রশ্ন এবং এটা একটা মীমাংসীত বিষয়। এখন সেক্ষেত্রে যারা জামাতের অনুসারী জামাত সক্রিয় না থাকলে তারা কোন দল গঠণ করবেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সেটা তারা তাদের মতো করে বিবেচনা করবেন। তার সাথে রাজনৈতিক লড়াই হবে৷ যারা তাদের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী নন তাদের সাথে একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে লড়াইটা চলবে। কিন্তু এই বিভাজনটাকে ব্যবহার করে আপনি নিজে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চাইবেন অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী পন্থায়, তাতে মুক্তিযুদ্ধের যে মৌলিক আকাংখা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।

জোনায়েদ সাকি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ লালন করেন, এটা রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই জানে৷ বাম রাজনীতির বলয়ে যে বিভক্তি সে বিভক্তিকে এড়িয়ে গেলে অনেকের কাছে তার অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে জায়গাটা মাথায় রেখেই জানতে চাইলাম, রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোতে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নে গণসংহতি কতোটুকু বিশ্বাসী?

সাকি বললেন, বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য শুরু থেকে লড়াই করছি। ২০০২ সালে গণসংহতি আন্দোলন একটা রাজনৈতিক মঞ্চ আকারে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে বামপন্থী আন্দোলন চলছে আমি সে আন্দোলন থেকে উঠে এসেছি। কিন্তু গণসংহতি আন্দোলন শুরুতেই বলেছিল, আমরা বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য লড়ছি। কারণ ২০০২ সালেও আমরা একই উপলব্ধিতে ছিলাম যে, দেশের রাষ্ট্রকাঠামোটা ক্ষমতা কাঠামোর দিক থেকে প্রবল স্বৈরাচারী। এটা মানুষের নূন্যতম অধিকার রক্ষা করতে দিচ্ছে না। কাজেই এদেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব জায়গায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ২০১৫ সালে আমরা যখন তৃতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গণসংহতি আন্দোলন কে রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করি সেখানেও আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ব্যবস্থা- এসবগুলোর একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য গণসংহতি আন্দোলন লড়াই করবে। ফলে বাংলাদেশে বিদ্যমান যে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা আছে, তাতে নূন্যতম একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার লড়াইটাকেই আমরা বিপ্লবী লড়াই মনে করি। ফলে আমরা সে লড়াইটি করছি। এ লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই আমরা সমাজে অধিকতর সমতা ভিত্তিক সমাজের জন্য স্বপ্ন দেখি।

অনেকদিন ধরে আমার, না শুধু আমার নয়, আমাদের অনেকের মাথায় একটা জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খায়। কেন আওয়ামী লীগ- বিএনপির বাইরে এখানে অন্য কোন রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রান্তিক পর্যায়ে বিকশিত করতে পারছে না বা কেন বড় দুটি দলের অনেক ভুল সত্ত্বেও অন্য কোন দল নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী ভাবে জানান দিয়ে জানগণকে কাছে টানতে পারছে না। সমস্যাটা কোথায়? এ জিজ্ঞাসাটাই তুলে ধরলাম জোনায়েদ সাকির কাছে। বললাম, গত বিশ বছরের পথচলার অভিজ্ঞতায় আপনার কী মনে হয়েছে? সীমাবদ্ধতাটা কোথায়?

জোনায়েদ সাকি বললেন, একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে বিকশিত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা এমন হয়েছে যেখানে একটা গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ নানা পর্যায়ে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আপনি ছাত্র আন্দোলনের কথা ধরুন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নাই। ফলে ছাত্ররা যে আন্দোলন করবে, নিজেদের দাবি নিয়ে সংগঠিত হবে, ছাত্রসংসদ নির্বাচনে যাবে, সে প্রক্রিয়ার ভেতর তারা যেতে পারেন না। শ্রমিক আন্দোলনের কথা ধরুন। তারা যে ট্রেড ইউনিয়ন করবে, দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবে এবং নানা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দাবি আদায় করবে- সেই প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি বন্ধ। সর্বশেষ কবে শ্রমিকরা তাদের কোন দাবি নিয়ে আন্দোলন করে সফল হয়েছে সেটা স্মরণ করতে পারবেন? পারবেন না। এরকম সবক্ষেত্রেই আন্দোলনের পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজের নানা পর্যায়ে অসঙ্গতি তৈরি হলে সেই অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে মানুষের দাবি দাওয়া সৃষ্টি হবে। মানুষ সেই দাবিকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং আন্দোলন করে দাবি আদায় করবে। এই দাবি মেনে নেওয়ার প্রক্রিয়া যে সমাজে আছে সেটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। দাবি মেনে নেওয়ার প্রক্রিয়াই যদি না থাকে তাহলে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো বিকশিত হবে কীভাবে? এই বিপুল প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমরা লড়াই করে চলেছি।

বাইরে সংহতি প্রকাশনের কেউ একজন কথা বলতে চাচ্ছেন। ছাত্র সংগঠনের দু'জন কর্মীও এসেছে মনে হয়। সেদিকে উনার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের আলাপ তখন তুঙ্গে।

বললাম, সাকি ভাই, আমি এমন একটা প্রশ্ন এখন করছি যেটা শুধু আমার প্রশ্ন নয়। বরং এদেশের অনেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের প্রশ্ন। প্রশ্নটা হলো, এদেশে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কখনো বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারবে এমনটা মনে করেন কী? যদি না পারেন কেন নয়? বামপন্থী দলগুলোর নেতা কর্মীরা তুলনামূলক ভাবে পরিচ্ছন্ন। বেশ পড়াশোনা করেন। খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলেন। তবু কেন মেইন স্ট্রীমের রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে পারছেন না?

এদেশে বামপন্থী দলগুলো গণমানুষের রাজনীতির কথা বলে। কিন্তু যখন গণমানুষের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্ন আসে সেক্ষেত্রে বামপন্থী দলগুলো কখনোই যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারে না। সেটা ১৯৪৭ সালের আগেই হোক আর ১৯৭১ সালের আগেই হোক! ফলে বিপুল বিস্তৃত সংগঠন সত্ত্বেও তারা রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেননি। জনগণের পক্ষে, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়া ও কাজ করা তাদের হয়ে উঠেনি। বরং তাদের মধ্যে আমরা কতোগুলো প্রবণতা দেখেছি। সেটা হলো লেজুড়বৃত্তি প্রবণতা এবং মুখ্য রাজনৈতিক প্রশ্নটাকে শনাক্ত করতে চরম ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা তারা ১৯৪৭ সালের আগেও দেখিয়েছে, ১৯৭১ সালের আগেও দেখিয়েছে, এমনকি ১৯৯০ সালের আগেও দেখিয়েছে। যখন স্বাধীনতার প্রশ্নটা সামনে আসল তখন তারা স্বাধীনতার প্রশ্নটাকে মুখ্য করে রাজনীতিকে সংগঠিত করতে সক্ষম হন নাই।  বিপুল সাংগঠনিক বিস্তার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের জমিন প্রস্তুতি সবটাইতো বাম দলগুলো করেছিল। কিন্তু এর নেতৃত্বটা চলে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের হাতে। একইভাবে ৭০ ও ৮০ দশকে নানা ধরনের স্বৈরাচারী শাসন- তার বিরুদ্ধেও বামপন্থী দলগুলো আন্দোলন করেছে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে যে মুখ্য রাজনীতির প্রশ্নটা তৈরি হয়েছে সেটাকে তারা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলতে কী বুঝায়, এই যে একটা জবাবদিহিতাপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতা কাঠামো সেটাকে কর্মসূচী আকারে তুলে ধরতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। বরং ১৯৭২ সালের যে সংবিধানে যেহেতু 'সমাজতন্ত্র' অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে আছে তারা সেটাকেই গণমানুষের পক্ষের সংবিধান হিসেবে তুলে ধরেছিল। কিন্তু তারা এটা খেয়াল করেনি, ১৯৭২ সালের সংবিধান যেভাবে তৈরি হয়েছে- এটা গণমানুষের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্যই কাজ করবে। এর বিপরীতে যে একটা গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য লড়াই করাটা প্রধান কাজ সেই কাজটা বামপন্থীরা করতে পারেননি৷ তারা যে সকল দাবি দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করেন সেগুলো একধরনের অর্থনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু একটা রাজনৈতিক সংগ্রাম অর্থাৎ ক্ষমতার প্রশ্নে যে লড়াই সেখানে উনাদের কোন ভূমিকা নেই৷ গণমানুষের রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হচ্ছে গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে চালু করা যায় সেই প্রশ্নটাকে তোলা৷ আমাদের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো যদি তা করতে না পারেন তাহলে তাদেরকে আমরা গণমানুষের রাজনৈতিক দল হিসেবে অভিহিত করতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু অর্থনৈতিক নানা দাবি দাওয়া থেকে শুরু করে জাতীয় সম্পদ রক্ষা সংক্রান্ত নানা আন্দোলনে বামপন্থী দলগুলোকে সক্রিয় ভাবে দেখি। আমরাও এসব বিষয়ে আন্দোলন করাটা জরুরী মনে করেছি। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি, যখনি রাজনৈতিক প্রশ্নটা আসে তখনি তারা হয় লেজুড়বৃত্তির মধ্যে আটকে যান নয়তো মুখ্য রাজনীতির প্রশ্নটা শনাক্ত করার যে অতীত ব্যর্থতা তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন।

আপনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন৷ আশি দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। বাম ছাত্ররাজনীতি করেছেন৷ গণসংহতি আন্দোলনের বয়স বিশ বছর হলো। এইযে দীর্ঘ যাত্রা, এই অভিজ্ঞতা নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন? গণসংহতি আন্দোলন কখনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারবে? জানতে চাইলাম আমি?

আমরা মনে করি, আন্দোলনের ভেতর দিয়ে গণমানুষের ভেতর থেকে একটা গণমানুষের রাজনৈতিক দল গড়ে উঠবে। ফলে এখানে যখন কোন আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যারাই সে আন্দোলন করুক না কেন, তাদের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা মনে করি আমাদের দলের একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে গণমানুষের রাজনৈতিক লক্ষ্যটাকে আরো সুস্পষ্ট করা এবং তার ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা৷ সেই কাজটাই আমরা করে চলেছি। এই কাজ করতে গিয়ে গণমানুষের মধ্যে বেশকিছুটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে পেরেছু বলে আমরা মনে করি। মানুষ আমাদেরকে, আমাদের রাজনীতিকে সমর্থন দেয়৷ তারা আমাদের উপর আস্থাও রাখেন। কিন্তু বিদ্যমান স্বৈরাচারী ব্যবস্থা এমনভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা দখল করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নাই করে দিয়েছে তাতে এরকম একটা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দল হিসেবে আমাদের বিকশিত হওয়ার জায়গাটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারী দলের একটা চেষ্টা হচ্ছে নতুন রাজনৈতিক শক্তি যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য বাধা সৃষ্টি করা। ২০০৭-০৮ সালে সামরিক নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল তারা বলেছিল, এখানে যাতে জবাবদিহিতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয় তার জন্য নাকি সহায়ক কাজ করবেন। আমরা দেখলাম, তারা সব উল্টো কাজ করলেন। অর্থাৎ তারা স্বৈরাচারী ক্ষমতা কাঠামোর প্রশ্নে কোন ধরনের রাজনৈতিক প্রস্তাবনা বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন ঐক্যমত তৈরিতে সচেষ্ট ছিলেন না। বরং আমরা দেখলাম, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের নামে কীভাবে পরবর্তী সরকার নিবন্ধনের আইনটাকে দমন পীড়নের কাজে ব্যবহার করতে পারে সেই হাতিয়ার তাদের হাতে তুলে দিল। এবং আমরা দেখলাম, ঐ সময় নিবন্ধনের যে শর্ত তৈরি করা হয়েছিল, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ঐ আইনটাকে আরো কঠোর করে এখন এটাকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও এখনো আমাদের নিবন্ধন আটকে রাখা হয়েছে। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় আমরা নূন্যতম গণতান্ত্রিক পরিসর পাচ্ছি না৷ নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে অধিকার তা পর্যন্ত হরণ করা হচ্ছে। এরকম একটা বাস্তবতার ভেতর দিয়ে আমরা রাজনৈতিক সংগ্রামটা করে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নতুন ধরনের সংগ্রামের উন্মেষ ঘটে। জনগণের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন সৃজনশীল নতুন নতুন উপায় সৃষ্টি হয়। সেই উপায়ের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে নতুন ঐক্যের সৃষ্টি হয়।

কথায় কথায় রাত অনেক হয়েছে। দু'জনকেই উঠতে হবে। বললাম, আজ শেষ করি। আবার শীঘ্রই কোন একদিন বসব। তিনি হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, সাংবাদিক হিসেবে আপনাকে একটা কথা বলি আদনান ভাই। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। বললেন, আমি যা আমাকে নিয়ে তাই লিখবেন ৷ বেশী বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলার দরকার নাই। রাজনীতিটা মানুষের জন্য করছি। নিজের জন্য নয়। আমি বিদায় সূচক হাত নেড়ে লিফটের বোতাম চাপলাম।

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা: আলী আদনান, লেখক ও সিনিয়র সাংবাদিক

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.