× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

‘আমার কষ্টের খবর কেউ ফেরি করেনা’

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

০৩ এপ্রিল ২০২২, ০৩:০৭ এএম

সৈয়দ আহম্মেদ

‘লাখো মানুষের সুখ দুঃখের খবর ফেরি করেছি। কিন্তু আমার কষ্টের খবর কেউ ফেরি করেনা’ আক্ষেপ করে এ কথা বলেন লক্ষ্মীপুরের সৈয়দ হকার। একশত এগারো বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মেদ। পেশায় তিনি ছিলেন একজন পত্রিকা বিক্রেতা। আশি বছর যাবত লক্ষ্মীপুরে পথে ঘাটে পত্রিকা নিয়ে হাজির হতেন মানুষের ধারে। স্থানীয়ভাবে সৈয়দ হকার নামে এ ব্যক্তিটি জীবনের আশিটি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পত্রিকা বিক্রি করে। এদিকে স্থানীয় পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাদেশে সবচেয়ে আদি পত্রিকা বিক্রেতা সৈয়দ আহম্মেদ।

তাঁর পুরো নাম সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর জন্ম তারিখ ১ মার্চ ১৯১১ সাল। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্চানগরের মকরম আলীর ছেলে সৈয়দ আহম্মদের জীবিত ৬ ছেলে ও মেয়েরাও ষাটোর্ধ বয়সী। ছেলেদের কোনভাবে সংসার চললেও ষাট বছর বয়সী স্বামী পরিত্যক্ত দুই মেয়ে আর শতবর্ষী স্ত্রীসহ চারজনের ভরণ পোষণের দায়িত্ব এখনো তাঁর ঘাড়ে। নিজের আর স্ত্রীর বয়ষ্কভাতা ছাড়া অন্য কোন আয় নেই এ বৃদ্ধের।

তবুও সৈয়দ আহমেদ হকার এখনো লাঠিতে ভর করে লক্ষ্মীপুর শহরে ঘুরে বেড়ায় জীবিকার সন্ধানে। চোখে ঠিকমতো না দেখলেও তিন বেলা আহারের খোঁজে প্রতিদিনই বের হয় পথে ঘাটে। পুরনো পত্রিকার গ্রাহকরা তাঁকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন।

লক্ষ্মীপুর শহরে তাঁর অতীতের কর্মস্থল রহমানিয়া প্রেসে কথা হলে এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরেন। এসময় বিভিন্ন পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখতে দেখতে চোখের দুকোণে জলগড়িয়ে পড়ে তাঁর।

প্রবীণ সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী জানায়, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলা এর পূর্বের লক্ষ্মীপুর থানার সব সময়ের হাজার ঘটনার সাক্ষী ছিল খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ আহম্মদ। পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। বাম হাতে একটি লাঠি আর কাঁধে ব্যাগ, পরনে পুরনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ডান হাতে পত্রিকা  নিয়ে ঘুরে ফিরতেন অলিগলি। কখনো কখনো লক্ষ্মীপুর শহরের পুলের উপরে বসেও পত্রিকা বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু তাঁর কাঁধে ঝোলানো আছে সে ব্যাগ আর পরনে পুরনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ও ডান হাতে লাঠি ও আছে। কিস্তু নেই শুধু পত্রিকা। এখন তার সময় যাচ্ছে কষ্টে।

লক্ষ্মীপুর পত্রিকা হকার সমিতির সভাপতি আনোয়ার জানান, পত্রিকার আয়ে তাঁর সংসার চলতো। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত পত্রিকা বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। সেকারণে এখনো শীর্ণ দেহে প্রতিদিনই বের হন মানুষের সহযোগিতার আশায়। বহু দিনের পরিচিত পাঠকরা কেউ কেউ কিছু সহযোগিতা করেন। এভাবে যা পান, তা দিয়েই চলে তাঁর।

রহমানিয়া প্রেসে বসে সৈয়দ হকার জানান, কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে নৌকায় কাজ করতেন। এর পর স্থানীয় এক মাওলানার সহযোগিতায় প্রায় ৮৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সন-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে ইংরেজ আমলে ভারতীয় পয়গাম পত্রিকা বিক্রি করেছেন। পরে আজাদ, ইত্তেফাক, যুগশঙ্খ আর সংবাদ পত্রিকা বিক্রি করতেন। দুই পয়সা, চার পয়সায় পত্রিকা বিক্রি শুরু করেছিলেন তিনি।


সৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময়ে ছোট এ লক্ষ্মীপুরে সরাসরি পত্রিকা আসতো না। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে রেলগাড়িতে পত্রিকা আসতো। সেখান থেকে বাসে করে লক্ষ্মীপুরে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। তারপর তা পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত প্রকাশের তিন-চার দিন পরে। প্রতিদিন পত্রিকা পৌঁছে দেয়াও সম্ভব হতো না। তিনি আরও জানান, কিছু সময় ডাকহরকরা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিত। তখনও সকালবেলার পত্রিকা  আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতেন তিনি।

এভাবে নিজের অজান্তেই পত্রিকার সাথে নিজের জীবনকে পুরো জড়িয়ে নেন সৈয়দ আহমদ। তার পর টানা প্রায় ৮০ বছর পত্রিকা বিক্রির সাথেই ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর থেকে আর পত্রিকা বিক্রি করতে পারছে না। কিন্তু অভ্যাসের কারণে প্রায় প্রতিদিনই এজেন্সিতে আসেন তিনি। পত্রিকা না পড়তে পারলেও উল্টিপাল্টিয়ে দেখেন।

অতীতের প্রসঙ্গ তুলতেই সৈয়দ আহমেদ ভূঁইয়া জানান, এ পত্রিকা বিক্রিকালেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-আন্দোলনসহ সব ঐতিহাসিক আন্দোলনের সাক্ষী তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে সৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময় ইত্তেফাক আর সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি করতে পারতেন না। প্রথম দিকে নিজে নিজে পত্রিকা বিক্রি শুরু করলেও এক সময় সৈয়দ আহম্মদের প্রধান আশ্রয়দাতা হন লক্ষ্মীপুরের প্রয়াত সাংবাদিক ও রহমানিয়া প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক গোলাম রহমান। তাঁর মৃত্যুর পর গোলাম রহমানের ছেলে মনোয়ার রহমান। মনোয়ার রহমানের পরে তার ছেলে রাকিব হোসেনও দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছিলেন সৈয়দ আহম্মদের সাথে।

রহমানিয়া প্রেসের পরিচালক রাকিব হোসেন জানান, ছোট বেলা থেকে দেখতাম প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসতেন সৈয়দ চাচা। মাঝে মাঝে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখতাম সৈয়দ কাকা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকতেন। অনেক সময় রাত পর্যন্তও  তিনি পত্রিকা বিক্রি করতেন। পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। শুরু হয় যেতো তাঁর কাজ। কাজের সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হতো না।

তিনি আরও বলেন, সৈয়দ আহমেদ ছিলেন কাগজ কলমে অশিক্ষিত কিন্তু তার হৃদয় ছিল আলোকিত। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চরম দুঃখ কষ্টে। তবুও হৃদয়বান এ মানুষটি শিশুদের পাঠশালার জন্য দান করেছেন পৌরসভার চার শতক জমি। আর মুসল্লিদের জন্য দিয়েছেন মসজিদের জায়গা।

এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যে মানুষটি আজীবন মানুষের নিকট জ্ঞান বিক্রি করেছেন, সমাজ আলোকিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু তার শেষ দিনগুলো যাচ্ছে চরম কষ্টে। বিগত আট দশকের খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ হকার এখন বার্ধক্য আর রোগ শোকে খুবই ক্লান্ত। এখন তার জীবন চলছে অত্যন্ত দু:খ কষ্টে। এক ছেলে আবুল কালাম (৬০) বাবার পেশা পত্রিকা বিক্রি ধরে রেখেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পত্রিকা বিক্রির পয়সায় তারও সংসার চলে না। অন্যদিকে তার চার মেয়ের মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা ষাটোর্ধ ২ জন বাবা মায়ের সাথেই সংসারে আছেন। এ চার জনের সংসারের ভার বৃদ্ধ সৈয়দ আহম্মদের ওপর। কোন আয় না থাকায় মানুষের সাহায্য আর সহযোগিতাই চলছে তাঁর সংসার।

লক্ষ্মীপুর শহরের ঠিকাদারি ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন পাঠান জানান, স্কুলজীবন থেকেই তিনি সৈয়দ আহম্মদকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখেছেন। তাঁর বাবাও দেখেছেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি বিনে পয়সায় তাঁকে পত্রিকা পড়তে দিতেন।

পত্রিকা পড়তে না পারলেও পত্রিকা বিক্রির প্রতি তাঁর অসম্ভব ঝোঁক ছিল। মাঝে মধ্যে যেদিন পত্রিকা বের হতো না সেদিনও তিনি পুরনো পত্রিকা নিয়ে বের হতেন। পত্রিকার প্রতি অন্য রকম নেশা ছিল তাঁর। কারো কাছে তিনি সৈয়দ চাচা, কারো কাছে তিনি সৈয়দ নানা হিসেবে পরিচিত।

শতবর্ষের এ আলোকিত মানুষটির জীবনে সব সময়ই নিত্যদিন সঙ্গী হচ্ছে অভাব। তবুও তিনি অত্যন্ত বড় হৃদয়ের মানুষ। এ আলোর ফেরিওয়ালা সৈয়দ হকারের জীবনের শেষ দিনগুলো কি এভাবে পথে ঘাটে আর কষ্টে যাবে এমন জিজ্ঞাসা সচেতন মহলের।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.