হৃদয় মণ্ডল
১৯৭১
সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা বিষয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তা হলো, যারা
ধর্ম ও রাজনীতিকে এক
করতে রাজী নয়, রাজনীতিকে যারা ধর্মের স্বার্থে ব্যবহার করে না তারা মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষে। আর যারা ধর্মকে
ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায় তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা করাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দাবি। মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র একটা ভৌগোলিক সীমারেখাকে রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন করার বা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা
করার লড়াই ছিল না। বরং যে দর্শনের ওপর
ভিত্তি করে ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের
ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল সেই দর্শনটা যেন আর স্বাধীন বাংলাদেশের
মাটিতে ঢালপালা মেলে বড় হতে না
পারে, কোন ধরনের বিষবাষ্প ছড়াতে না পারে- তারও
লড়াই।
যদিও
১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল তথাপি মাত্র কয়েকবছর পরেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রসমাজের আসাম্প্রদায়িক আন্দোলন প্রমাণ করেছিল, বাঙালিরা কখনোই সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আলাদা জাতিসত্ত্বার
পরিচয় নির্ধারন করতে রাজি নয়। সে জন্যই শুধু
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদে
উদ্বুদ্ধ তরুণেরা সেদিন প্রতিবাদ করেছিল। একইভাবে আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব যখন আসল এবং নানা ধরনের ধর্মীয় যুক্তি দেখিয়ে তার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করা হলো তখনো কিন্তু বাঙালিরা মেনে নেয়নি। আমি এখন যে বাংলা অক্ষরে
লিখছি তাও কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি তরুণদের আন্দোলনের ফসল।
১৯৬৭
সালে পাকিস্তান সরকার এদেশে রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন জাতীয় পরিষদে খান এ সবুর বক্তৃতা
করতে গিয়ে বলেছিলেন, রবীন্দ্রসংগীত ও বাংলা নববর্ষ
হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির অংশ। তা এখানে চলবে
না। (১৯৬৭ সালের জুন মাসের ২৩- ২৭ জুনের দৈনিক
পাকিস্তান ও অবজারভার পত্রিকায়
এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।) তখনো বাঙালিরা যেমন মন থেকে হিন্দু-
মুসলমান বিভেদ মেনে নেয়নি তেমনি প্রমাণিত হয় ধর্মকে পুঁজি
করে যারা বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের সাথে আমাদের একসাথে চলা কঠিন। এভাবে নানা কারণে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম ধর্মান্ধ পাকিস্তানের গন্তব্য আর অসাম্প্রদায়িক ও
ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির গন্তব্য এক নয়।
অর্থাৎ
মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র আমাদের রাজনৈতিক বা সার্বভৌমত্বের লড়াই
ছিল না। বরং এটা ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই। উগ্র, ধর্মান্ধদের প্রতিহত করে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই। ধর্মের পরিচয়ে যারা আমাদের ভাই সেজেছিল সে পাক হানাদাররা
যখন এখানে গণহত্যা চালিয়েছে তখন হিন্দু অধ্যুষিত ভারত বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। নানা ভাবে সহযোগিতা করেছে। মানুষের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে
ধর্মীয় পরিচয় কখনোই বড় পরিচয় নয়,
তা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসেও বারবার
প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৭২
সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অগণিত লাশ ও ধ্বংসস্তুপের উপর
দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান। ইতিহাস এই সংবিধানকে ৭২
এর সংবিধান হিসেবে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়। ৭২ এর সংবিধানে
যারা প্রণেতা তারা কিন্তু ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনগণের
ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। অর্থাৎ যেসব দাবির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। যার অন্যতম দুটি স্তম্ভ ছিল ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ' ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।
যে
সকল দাবির ভিত্তিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেসকল দাবির ভিত্তিতেই বাংলাদেশ পথ চলবে, এটা
একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ‘প্রতিষ্ঠত সত্য’
শব্দ দু'টি এজন্য
ব্যবহার করছি কারণ ত্রিশ লক্ষ শহীদ নিজের জীবন দিয়ে এ সত্য প্রতিষ্ঠা
করে গেছেন। রাজনীতিতে, ক্ষমতা আরোহনে, ক্ষমতার ডিগবাজিতে অনেক ধরনের ভনিতা থাকতে পারে। রাজনীতির নাট্যমঞ্চে কুশীলবরা নানা ধরনের রোল প্লে করতে সক্ষম। সেসব নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশ কিসের ভিত্তিতে, কীভাবে চলবে, শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক চিন্তার খোরক হয়ে এদেশের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে নাকি বাংলাদেশ সবার জন্য সমান, আমরা আগে বাঙালি নাকি আগে মুসলমান- এসব তর্ক কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে
সমাধান হয়ে গেছে এবং তারই ভিত্তিতে আমাদের পথচলাও শুরু হয়।
কথা
ছিল শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সেটা হয়নি। আমাদেরকে পেছনেও হাঁটতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্য, পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ভেতর দিয়ে আমাদের উল্টো রথের যাত্রা শুরু হয়। ঠিক যে চিন্তা থেকে
একদিন বাংলা কেড়ে নিয়ে উর্দু চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, যে চিন্তা থেকে
আরবী হরফে বাংলা লেখানোর তাগিদ দিয়েছিল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী, যে
চিন্তা থেকে এখানে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল- সেই একই চিন্তা থেকেই এখানে ‘জয় বাংলা'র
স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র জায়গায় আসে
রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। যে খান এ
সবুর একদিন রবীন্দ্রসংগীত ও বাংলা নববর্ষকে
হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলেছিল, যে খান এ
সবুর মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে
গ্রেফতার হয়েছিল, সেই খান এ সবুর ১৯৭৯
সালে খুলনা থেকে তিনটি আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান। খান এ সবুরদের একই
আদর্শের দোসররা বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুণরায় নতুন গতিতে যাত্রা শুরু করে।
(দুই)
বাংলাদেশের
রাজনীতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একমাত্র শক্তিশালী ও সংগঠিত দল।
রাজনীতি দিযে রাজনীতি মোকাবেলায় দলটি ইতোপূর্বে যেসব পারদর্শীতা দেখিয়েছে তা দেখে এদেশে
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার
মানুষেরা আওয়ামী লীগকেই তাদের চিন্তা ও চেতনার একমাত্র
ঠিকানা মনে করলে তাতে দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই। যে যাই বলুক,
এদেশের রাজনীতিতে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালনকারী দল নিজেদেরকে প্রান্তিত
রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে ও সংগঠিত শক্তি
হিসেবে প্রমাণ দিতে পারেনি।
ফলে,
একদিকে যেমন আওয়ামী লীগের দায়বদ্ধতা বেড়েছে তেমনি অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করেন এমন মানুষের প্রত্যাশাও বেড়েছে। মানুষ ইতিহাসের কথা মাথায় রেখেই প্রত্যাশা করে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা হবে অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। মেধা, মননে, প্রজ্ঞায় তারা অন্যদের চেয়ে আধুনিক হবে, এগিয়ে থাকবে, প্রতিবাদি হবে। যে আওয়ামী লীগ
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে সে আওয়ামী লীগের
নেতাকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক চিন্তার হবে, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়িয়ে দিতে কাজ করবে, ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিবে না- এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা হয়নি।
আমি
এ লেখায় অন্যকোন রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে কথা বলব না। প্রত্যাশার জায়গা থেকে আওয়ামী লীগকে নিয়েই বলি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীরা তাদের দায়বদ্ধতার জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা যে এককথা নয়
তা বর্তমান আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীর বোধে নেই। একসময়ের কর্মীনির্ভর আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণেই হোক বা অন্যকোন কারণেই
হোক দলের ভেতরে হয়ে উঠেছে পুঁজিপতি ও শিল্পপতি নির্ভর।
আর সরকারে হয়ে উঠেছে আমলা ও প্রশাসন নির্ভর।
ফলে
ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত আপোষ
ঘরে বাইরে সবজায়গায় করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। যারা মেধাভিত্তিক রাজনীতিকে প্রাধান্য দিত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ যাদের কাছে প্রাধান্য পেত, দলে ও সরকারে আজ
তারা অসহায়- এমনটি অভিযোগ অনেকের। এর সুদূরপ্রসারী ফল
কী হতে পারে তা নিয়ে আওয়ামী
লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের ভাবনা জানা না গেলেও সুশীল
সমাজ, দলের পুরনো নেতাকর্মী ও রাজনীতি সচেতন
মানুষ যে শংকিত তা
নিয়ে সন্দেহ নেই।
যেহেতু
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অন্যদলগুলোর রাজনীতি চর্চার সুযোগ কমেছে সেহেতু আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিধাশ্রেণীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে ব্যাপকহারে। বিভিন্ন মতাদর্শের লোক এসে আওয়ামী লীগে দলে দলে ভিড় করছে। যারা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে সাময়িক লাভের আশায় আওয়ামী লীগে এসেছে তাদের কণ্ঠই আজ সবচেয়ে বেশি
জোরালো। পক্ষান্তরে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতা
কর্মীরা অসহায়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুতে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী এ সুবিধাবাদী শ্রেণীটির
চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষ তাদের প্রত্যাশার জায়গায় এসে তখন হোঁচট খায়।
মানবতাবিরোধী
অপরাধের দায়ে যখন দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর সাজা ঘোষণা করে আদালত তখন আমরা দেখি আওয়ামী লীগের কেউ কেউ সেই রায়ের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ঐ একই ব্যক্তির
মুক্তি চেয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দিতে আমরা অনেককে দেখি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যারা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর মুক্তি চাচ্ছে তাদের কারো কারো ফেসবুক কাভার ফটোতে যখন বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখি, প্রোফাইলে ড়িৎশং ধঃ ছাত্রলীগ বা
ড়িৎশং ধঃ যুবলীগ লেখা
দেখি তখন আমাদের অংক ঠিক মেলে না।
একইভাবে
যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার বিভিন্ন মন্ডপে হামলা হয় তখনো আমরা
এমন অনেককে দেখি যারা নিজেদের আওয়ামী লীগের কর্মী, সমর্থক পরিচয় দিলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় উস্কানিমূলক বিভিন্ন পোষ্ট দিতে খুব উৎসাহী হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পুড়তে দেখে যারা উল্লাসে ফেটে পড়ত তাদের সাথে এদের কোন পার্থক্য তখন আমরা নির্ণয় করতে পারি না। ফেসবুকের কাভার ফটোতে বঙ্গবন্ধুর ছবি বা প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার ছবি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্যের বিরুদ্ধে বিতর্কিত হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সাথে সুর মিলিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়- এমন আওয়ামী লীগ কর্মী পরিচয়ধারীরা কি আমাদেরকে বিভ্রান্তিতে
ফেলে দেয় না?
একজন
জামায়াতের কর্মী বা সমর্থক যে
চিন্তা লালন করে সেই একই চিন্তা যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবিদার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে, ঘরে সাপ ঢুকেছে। তবে সাপ এতো কৌশলে কুন্ডুলি পাকিয়ে নিজেদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করে নিচ্ছে যেখানে সাপ চিহ্নিত করা আসলেই কঠিন!
(তিন)
আমি
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে নিয়মিত ও সক্রিয় মানুষ।
বিশেষ করে ফেসবুকের নানা গলিতে আমি বিচরণ করি তরুণদের মানসিকতা বুঝার জন্যই। অতি সম্প্রতি দুটো ঘটনায় বেশ হৈচৈ পড়েছে। একটা হলো টিপ কান্ড। অন্যটি হলো, বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডল গ্রেফতারের ঘটনা। দুটি ঘটনাই জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যান্ত দুঃজনক ও লজ্জাকর। পুলিশের
কনস্টেবল নাজমুল তারেক প্রকাশ্যে শিক্ষক লতা সোমাদ্দারকে “টিপ পরছোস ক্যান”
বলে মৌখিক আক্রমন ও নাজেহাল করলে
সারা দেশের অধিকার সচেতন মানুষ যখন সোচ্চার হয়ে উঠলো তখন একটা বিষয় আমাকে আতঙ্কিত করেছে। তা হলো, টিপ
কান্ড নিয়ে যতোগুলো নিউজ বিভিন্ন পোর্টালে হয়েছে প্রত্যেকটির কমেন্ট বক্সে তারাই এসে লতা সোমাদ্দারকে আক্রমণ করেছে যাদেরকে আমরা ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি মনে করি। আবারো ধর্মের দোহাই তুলে নারীকে অবমাননার যে ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত
এই ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে দেখলাম তাতে প্রমাণিত হয় এরা তাদেরই
আদর্শিক সন্তান যারা মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আরবী হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছিল। এরা তাদেরই একই পথের পথিক যাদের পক্ষ নিয়ে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে মুসলিম লীগ নেতা ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের
অন্যতম বিরোধীতাকারী খান এ সবুর পার্লামেন্টে
দাঁড়িয়ে বলেছিলেন বাংলা নববর্ষ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত
হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি!
খান
এ সবুর এবং উনার স্বজাতি ভাইরা যেমন বাঙালিয়ানার মধ্যে হিন্দুয়ানা দেখতেন এখনো এ রাষ্ট্রে সেই
প্রজন্ম বড় হচ্ছে যারা
বাংলা নববর্ষে হিন্দুয়ানা দেখে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় হিন্দুয়ানা দেখে। টিপের ভেতর হিন্দুত্ব দেখে। শাড়ীতে, চুড়িতে দেবী দেখে। শহীদ মিনারে, স্মৃতিসৌধে, ভাস্কর্য্যে, প্রভাতফেরীতে- সব জায়গায় ধর্মের
অবমাননা দেখে। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি এটা স্বীকার করতে তাদের হাজার দ্বিধা পেয়ে বসে। আরবের মুসলমানরা যেমন আরব জাতি তেমনি ধর্মীয় দিকে মুসলমান তেমনি আমরা হাজার বছরের ঐতিহ্য
ও সংস্কৃতি লালনের ভেতর দিয়ে জাতি হিসেবে বাঙালি এবং ধর্মীয় অনুশীলনের দিক দিয়ে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। এ সহজ সত্যটুকু
আমরা স্বীকার করতে এখনো পারিনি। এখানে এসেই প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কতোটুকু সক্ষম হলাম!
বিজ্ঞান
শিক্ষক হৃদয় মন্ডল যেভাবে ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ফেঁসে যান, তাতে বুঝতে বাকি নেই- এভাবে চলতে থাকলে এ প্রজন্মের কাছে
একদিন মানুষের চেয়ে ধর্ম বড় হয়ে উঠবে।
জ্ঞান সাধনার জায়গাগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। বিজ্ঞান ও দর্শনকে অপ্রয়োজনীয়
ভেবে ছুঁড়ে ফেলবে। সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ছেয়ে যাবে অরাজকতায়। যখন মানুষ নিজেরাই নিজেদের হত্যা করবে ধর্ম অবমাননার অজুহাত তুলে। সেদিন মানুষের চেয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। এ জনপদ হয়ে
উঠবে অস্থির, অসহিষ্ণু ও অসহনশীল। সেটাই
যদি হয় তাহলে মহান
মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থকতা কোথায়?
একটা
রাষ্ট্রের সমাজ কাঠামো কেমন হবে, ভবিষ্যত প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নির্ভর করে
সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মান কেমন তার উপর। শিক্ষাব্যবস্থা, দর্শন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি- সবকিছুর গতিপথ নির্ধারণ করে দেয় ঐ রাষ্ট্রের রাজনীতি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব আমাদের জন্য অশনি সংকেত। আর তাই আরবী
হরফে বাংলা লিখতে ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণরা আপত্তি করলেও প্রায় আশি বছর পরে এসে আজকে বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ফেঁসে যেতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে শাড়ী ব্লাউজ পরিহিতা নারীদের কেউ টিপ্পনী কাটার সাহস না করলেও আজ
লতা সমাদ্দারকে প্রকাশ্যে হেনস্তা হতে হয় টিপ পরার
কারণে। প্রশাসন থেকে স্কুলের ক্লাস রুম, খেলার মাঠ থেকে ড্রয়িং রুম- সবজায়গায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ডালপালা মেলছে হৃদয় মন্ডলদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে। পরাজয়টা শুধু হৃদয়
মন্ডলের নয়। পরাজয় পুরো সমাজ ব্যবস্থার, পরাজয় মুক্তিযুদ্ধের উত্তর প্রজন্মের।
এখনো
সময় শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক শক্তি হিসেবে আমরা যাদের কাছে প্রত্যাশা রাখি তাদেরকেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নয়তো সাম্প্রদায়িকতার কালো ধোঁয়ায় মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু দেখা যাবে না। বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মন্ডল সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে মুক্তি পাক - বাংলা নবর্ষের আগমনী ধ্বনিতে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh