× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ভাষা সংগ্রামীদের কথা

ভাষা আন্দোলন করে সরকারি চাকরি হারান মমতাজ বেগম

সাজেদা হক

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৭:২৪ এএম । আপডেটঃ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:২২ এএম

মমতাজ বেগম মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী নাম। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় তিনি চরমভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হন। এমনকি দীর্ঘ কারা ভোগ পর্যন্ত তাকে করতে হয়। ১৯২৩ সালের ২০ মে কলকাতার হাওড়া জেলার শিবপুরে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। ডাক নাম মিনু। তার বাবা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায় এবং মা মাখন মতি দেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী ছিলেন তার মামা।

সম্ভ্রান্ত কিন্তু অত্যন্ত রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে পড়াশোনার তেমন সুযোগ পাননি তিনি। তবুও নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপরই তার পরিবার থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। নিজের অনড় সিদ্ধান্তের কারণে তার পরিবার অবশেষে তাকে কঠিন পর্দাঘেরা নিয়মের মধ্যে পড়াশোনার সুযোগ দেয়। তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিএড পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৮ সালে এডুকেশন ওয়ার্কশপ ফর টিচার্স কোর্স সম্পন্ন এবং ১৯৬৩ সালে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার দি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় যোগদান করেন। ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর তিনি ময়মনসিংহে চলে আসেন এবং শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে সাত মাস শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে আনন্দময়ী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে এবং পরে কিছু সময়ের জন্য আহমদ বাওয়ানী জুট মিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদে চাকরি করেন। তাছাড়া শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে ‘শিশু নিকেতন’ নামের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পরবর্তীতে সিভিল সাপ্লাই অফিসের উ”চপদ¯’ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাফকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি মমতাজ বেগম নাম গ্রহণ করেন। কিš‘ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তার সংসার ভেঙে যায়। তিনিই একমাত্র মহিলা যাকে ভাষা আন্দোলন করার দায়ে তার স্বামী তালাক দেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মর্গান হাইস্কুলের নিকটস্থ রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে মর্গ্যান স্কুলের ছাত্রীসহ মহিলাদের প্রথম মিছিল নিয়ে উপস্থি’ত হন মমতাজ বেগম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। বিক্ষুব্ধ জনতা সারাদেশে সভা-সমাবেশের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিশাল মিছিল বের করে। এতে নারীদের নিয়ে অন্যতম নেতৃত্ব দেন মমতাজ বেগম।

চরম বাধা এবং রক্ষণশীল পরিবেশের মধ্যেও নারীদের একত্র করে মিছিলে অংশগ্রহণ করা এবং ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে গোপন কার্যক্রম চালানোর দায়ে পুলিশ তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। উল্লেখ্য, তিনি ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য তৎকালীন রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক ও মতবিনিময় করতেন। আদমজী জুট মিল শ্রমিকদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করে তাদের আন্দোলনে উৎসাহিত করেন।

২৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তাকে গ্রেপ্তার করে হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কোর্ট তার জামিন নামঞ্জুর করেন। সংবাদ পাওয়া মাত্র ক্ষেপে ওঠে নারায়ণগঞ্জবাসী। উত্তেজিত জনতা থানা ঘেরাও করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ; কিন্তু চাষাঢ়া পর্যন্ত যেতেই জনতার বিশাল বাধার মুখে পড়ে পুলিশ। শুরু করে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ; কিš‘ উত্তেজিত জনতার বিশাল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ। ঢাকা থেকে আসে পুলিশ এবং ইপিআরের ফোর্স। এদিকে উত্তাল নারায়ণগঞ্জবাসী চাষাঢ়া থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তার প্রায় ১৬০টি গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ-জনতার তীব্র সংঘর্ষে আহত হন শত শত ব্যক্তি। শতাধিক গ্রেপ্তার হন। গণগ্রেপ্তার এবং লাঠিচার্জের মুখে রাতের বেলা একটি ট্রাকে করে মমতাজ বেগম এবং তার সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়। এই সংবাদ দৈনিক আজাদ, ভারতের দ্য স্টেটসম্যানসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এরপর সরকার মমতাজ বেগমকে শর্তাধীন বন্ড সইয়ের মাধ্যমে মুক্তি দিতে চাইলেও তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাকে দীর্ঘ কারাভোগ করতে হয়। সরকারি চাকরিও হারাতে হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের কারণে প্রথম এবং একমাত্র চাকরিচ্যুত মহিলা হলেন তিনি। ১৯৫৩ সালের মে মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ৬০ বছর পর ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। তার সম্মানে নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান হাইস্কুলের সামনের সড়কটির নাম ‘ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’ রাখা হয়েছে। বেগম মমতাজ, একুশের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম নারী যিনি সর্বাধিক সময় ধরে কারা ভোগ করেন। প্রায় দেড় বছর কারা ভোগ শেষে মুক্তি পান তিনি। এরপর শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ মারা যান।




Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.