× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা জামায়াত বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও ঘটনাবহুল ২০২৪ সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

দালালের খপ্পরে লবণচাষীরা, কক্সবাজারে লবণ শিল্পে বিপর্যয়ের আশংকা

এ. এম হোবাইব সজীব,কক্সবাজার প্রতিনিধি।

২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫২ পিএম । আপডেটঃ ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৩ পিএম

ছবিঃ সংবাদ সারাবেলা।

এ যেন এক রূপ কথার গল্পের মতোই । সবার ভাগ্য দিন দিন বদলায় আর লবণ চাষীদের ভাগ্য যেন কোন মতেই বদলায় না। তাঁদের স্বপ্ন যেন আজীবন বন্দী দালালদের হাতেই। লবণ মাঠের জমি থেকে লবণ কেনাবেচা সব খানেই মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা দালালদের দাপট। পুরো মৌসুমেই দালালদের কাছেই অসহায় কক্সবাজার উপকূলের প্রান্তিক লবণ চাষীরা।

কক্সবাজার যা দেশের অন্যতম প্রধান লবণ উৎপাদন এলাকা হিসেবে পরিচিত, বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এখানকার লবণ শিল্পে জড়িতদের। এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে লবণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। প্রতিবছর এখানে লাখ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়। কিন্তু সম্প্রতি বাজারে লবণের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় এই শিল্পে জড়িত মানুষদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

স্থানীয় চাষিদের মতে, বর্তমান লবণের বাজারদর ৩০০-৩৫০ টাকা প্রতি মণ, যা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। এতে চাষিদের একদিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে লবণ উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাষিরা বলছেন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন, দেশে লবণের পর্যাপ্ত উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও বিদেশি লবণ আমদানি করা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়।

জেনাগেছে জেলার উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী ও কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়ার একাংশ, টেকনাফ ও কক্সবাজার সদরের একাংশে এসব লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী দালাল, ফড়িয়াদের খপ্পরে পড়ে ঘাটে ঘাটে ঠকছে লবণচাষিরা। পলিথিন ঋণ থেকে শুরু করে কঠিন শর্তে জমি বর্গা নেওয়া ছাড়াও সস্তায় লবণ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। মাপের ক্ষেত্রেও ঠকানো হয় চাষিদের।

লাভের হিস্যা প্রায় পুরোটাই চেপেপুটে খেয়ে নিচ্ছে দালাল, ফড়িয়ারা। তারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। তাদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। দালাল ফড়িয়াদের সিন্ডিকেট ‘শোষণের দোকান’ খুলে হাতিয়ে নিচ্ছেন বড় অঙ্কের টাকা।

জানা গেছে, ওইসব এলাকায় ৭ থেকে ৮ বছর ধরে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদনের কারণে খরচ বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু এই বাড়তি খরচ মেটাতে গিয়েই বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের লবণচাষিরা।

চাষিরা জানিয়েছেন, অনেক চাষি নিজস্ব টাকা আগাম পরিশোধ করে জমির মালিক ও ফড়িয়া ব্যবসায়ী থেকে জমি বর্গা নেন। জমি বর্গা নিলেও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে পলিথিন কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে তারা ফড়িয়া দালালদের শরণাপন্ন হন। চাষিদের এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে দালাল, ফড়িয়ারা খুলে বসে ‘শোষণের দোকান’।

টেকনাফের লবণ চাষি আবদুল মাবুদ জানান, আমাদের এখানকার লবণ দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারে। কিন্তু বিদেশি লবণ আসার পর বাজারে দাম পড়ে গেছে। আমরা যে খরচ করে লবণ উৎপাদন করি, সেটা তুলতেই পারি না। এই পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে টিকে থাকব?  লবণ উৎপাদন একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা। বছরের শুষ্ক মৌসুমে এখানকার মানুষ সূর্যের তাপ ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে লবণ চাষ করেন। কিন্তু উৎপাদন খরচ, জমি ইজারা, শ্রমিকের মজুরি এবং পরিবহন ব্যয়ের কারণে তাদের লাভের মুখ দেখা কঠিন হয়ে উঠছে। উপরন্তু, আমদানিকৃত লবণের দামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তারা প্রায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ফড়িয়া, দালালরা চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ আরো কয়েকটি এলাকা থেকে পলিথিন আমদানি করে। আমদানি করা এসব পলিথিন তারা চাষিদের কাছে দাদন হিসেবে দেয়। এই দাদন নিতে গিয়েই নিঃস্ব হয় চাষিরা। চাষিদের অভিযোগ, ফড়িয়ারা প্রতি পাউন্ড পলিথিন ৩০ থেকে ৪০ টাকায় ক্রয় করেন। কিন্তু চাষিদের কাছে বিক্রি করে ৬০ টাকার ওপরে। এসব পলিথিন স্থানীয় বাজারে নগদ টাকায় ক্রয় করলেও চাষিরা পাউন্ড প্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা কম মূল্যে কিনতে পারতেন। এছাড়া ফড়িয়াদের পলিথিন অনেক সময় খুবই নিম্নমানের হয়। তবুও চাষিদের নিরূপায় হয়ে বাড়তি দামেই ক্রয় করতে হয়। এটা হলো ‘শোষণের’ প্রথম ধাপ।

অপরদিকে, বেশি দামে বাকিতে পলিথিন কিনে শোষণের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পায় না চাষিরা। কারণ উৎপাদিত লবণ ওই দালালদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। ওই দালাল, ফড়িয়ারা বাজারের চেয়ে কম দামে চাষিদের লবণ বিক্রি করতে বাধ্য করে। না করলে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জোর করে লবণ মেপে নিয়ে যায়। আবার দাদন দেওয়া ফড়িয়া/দালালরা লবণ মাপার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কারচুপির আশ্রয় নেয়। নানা কৌশলে এক মণ লবণ ৪০ সেরের বদলে ৪৫ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লবণ উৎপাদন সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে ফড়িয়া/দালাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দাদনের ফাঁদে ফেলে চাষিদের রক্তের বিনিময়ে উৎপাদিত লবণের লভ্যাংশ চুষে নিচ্ছে। ফড়িয়া/দালাল সিন্ডিকেট চাষি ও লবণ মিল মালিকদের মধ্যস্থতার নামে লবণের বেচাকেনায় একটি মোটা অংশ লুটে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় শুধু চাষিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সবসময় মিল মালিক ও ফড়িয়া/দালালদের মধ্যে যোগাসাজশ থাকে। লুটে নেওয়া ভাগের কিছু অংশ মিল মালিকও। 

 কালারমারছড়ার লবণচাষি মোহাম্মদ আলম জানান, দেশীয় বাজারে লবণের দাম যদি মণপ্রতি ৫০০ টাকা হয় তখন ফড়িয়া/দালালরা সিন্ডিকেট করে তা গোপনে রাখে। তারা মণপ্রতি ৫০০ টাকা দরের লবণ চাষিদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা দরে কিনে নেয়। নিরূপায় চাষিরা বাধ্য হয়ে কম দামে লবণ বিক্রি করেন। সেখানে মণপ্রতি ১০০ টাকা ফড়িয়া/দালালরা লুটে নেয়। শুধু তাই নয়; রেওয়াজ মতে, চাষিদের কাছ থেকে মণপ্রতি আরো ২০-৩০ টাকা কেটে নেয় এ চক্র।

অনেক চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দীর্ঘকাল ধরে লবণ চাষ করেও দরিদ্রতা কাটছে না, আর দালালরা অল্প দিনেই ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ হয়ে যাচ্ছে। অনেক দালাল কয়েক বছরের মধ্যে কোটি কোটি টাকা বানিয়ে ফেলেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার লবণ উৎপাদন অধ্যুষিত মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়ার একাংশ, টেকনাফ ও কক্সবাজার সদরের একাংশ মিলে তিন শতাধিক দালাল রয়েছে। এসব দালালের উপজেলা-ভিত্তিক সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করে পুরো উপজেলার লবণ বাজার। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সময়ই প্রশাসনের নজরদারি পড়ে না। তাই নানা কূটকৌশলে দিনের পর দিন চাষিদের ‘রক্ত’ চুষে খাচ্ছে দালাল সিন্ডিকেট।

মহেশখালীর উপজেলার ধলঘাটার লবণচাষি মোহাম্মদ করিম উল্লাহ বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পরের জমি বর্গা নিয়ে লবণ চাষ করি। বাধ্য হয়ে দালালের কাছ থেকে দাদন হিসেবেই পলিথিন নিই। অনেক কষ্টে উৎপাদন করি লবণ। কিন্তু আমাদের এই ‘রক্তঝরা’ পরিশ্রমে উৎপাদিত লবণের মুনাফা লুটে খাচ্ছে দালালরা।’

মহেশখালীলী লবণ চাষী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মাসুম বলেন, কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ পুরো বাংলাদেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। এটা অত্যন্ত বড় অবদান। মূলত এর কৃতিত্ব চাষিদের। কিন্তু চাষিরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য না পাওয়া ও ফড়িয়া সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই পরিস্থিতি উত্তরণ করে চাষিদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

কক্সবাজার বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, মিল মালিকদের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যাতে তারা সরাসরি মাঠে গিয়ে চাষীদের কাছ থেকে লবণ ক্রয় করে। অন্তত এটি করা গেলে আর মধ্যস্বত্বভোগীরা দালালীর সুযোগ নিতে পারবেনা। জেলায় গত বছর লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮শত ৯০ মেট্টিক টন। চলতি মৌসুমে টার্গেট ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ৯০ হাজার মেট্টিক টন।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.