কিশোরগঞ্জের হাওরের বিশাল ঢেউ যেন এখন ‘মৃত্যুর দরিয়া’য় পরিণত হয়েছে। হাওরের পানিতে গোসল করতে নেমে শিশুসহ অনেকে মারা যাচ্ছেন। আবার হাওরের সৌন্দর্যের টানে ছুটে এসে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক পর্যটক। লাইফ জ্যাকেট না পড়ে হাওরে সাতার কাটার ফলে বেশির ভাগ পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ বছর বর্ষার ভরা মৌসুমে নতুন পানি প্রবেশ করার পর গত দুই থেকে আড়াই মাসে শিশু, পর্যটকসহ অন্তত ১৬ থেকে ১৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
মিঠামইন উপজেলা সদরের স্থানীয় বাসিন্দা মো: করিম সহ অনেকে বলেন, কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা মিঠামইন, অষ্ট্রগ্রাম, ইটনা, করিমগঞ্জ, নিকলী, বেড়িবাঁধসহ কয়েকটি সেতু ও রাস্তা রয়েছে। এ ছাড়া হাওরের বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে নজর কাড়া অলওয়েদার সড়ক। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য ডেকে আনছে অনেক পর্যটক। পর্যটকরা এখানে এসে হাওর দেখার পাশাপাশি ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার ও গোসলে নামেন। অনেকে নৌকা ভাড়া করে দল বেঁধে ছুটে চলেন হাওরের মাঝে। এ সময় অনেকে নিরাপত্তার কথা ভুলে যান। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানার কারণে লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে।
ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত আড়াই মাসে হাওরে অন্তত ১৬-১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে গত শুক্রবার ২২ জুলাই কিশোরগঞ্জের নিকলীর হাওরে ঘুরতে গিয়ে পানিতে ডুবে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় জীবিত উদ্ধার করা হয় অপর দুজনকে। নিকলী উপজেলা সদরের কুর্শা হাওরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আকাশ মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ রাজদি গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে।
অন্যদিকে আহত তুহিন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার নান্দিনা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে এবং আহত হাসিব পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার কিসমত রামপুর গ্রামের ফরিদ সিকদারের ছেলে।
এছাড়াও গত সোমবার (১৮জুলাই) সন্ধ্যায় শখের বশে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে মিঠামইন উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তা মো. হোসাইন হিমেল (২৯) পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন। সোমবার সন্ধ্যায় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অল ওয়েদার সড়কের সেতুর কাছে জাল দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে তিনি প্রবল স্রোতে তলিয়ে যান। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলের প্রায় একশ গজ দূর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নিখোঁজ হোসাইন হিমেলের লাশ উদ্ধার করে।
১৪ জুলাই জেলা শহরের গাইটাল এলাকার বাসিন্দা হিমেল মিয়া (২৮) পরিবারের সঙ্গে হাওরে বেড়াতে গিয়ে করিমগঞ্জ-মিঠামইনের সংযোগস্থলে গোসল করতে নামেন। একপর্যায়ে পানির স্রোতে তলিয়ে যান। পরদিন তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১৬ জুন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নৌকা থেকে হাওরের পানিতে পড়ে যান কিশোরগঞ্জ সদর ছাত্রলীগের নেতা হাবিবুল্লাহ হাবিব (২৮)। দুদিন পর ঘটনাস্থলের অদূরে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৩ জুন ইটনায় নৌকাডুবিতে তাড়াইল দামিহা এলাকার মো. মাসুম মিয়া (২৫), করিমগেঞ্জর হালগড়া এলাকার মো. সিরাজ উদ্দিন (৩৫) ও ইটনার বেতেগাঁও এলাকার মো. ওয়াসীম মিয়া (৬০) মারা যান। এ ছাড়া গোসল করতে নেমে মো: সোহান (৬), শাবনুর (৮) ও সানজিদা (১১) পানিতে ডুবে মারা যায়। এভাবে গত আড়াই মাসে বিভিন্ন কারণে বর্ষার পানিতে তলিয়ে অন্তত ১৬ থকে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগেও গত ২০২০ ও ২০২১-এ হাওরে ডুবে ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু এ বছর মাত্র আড়াই মাসেই গত এক বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন কর্মকর্তা আবুজর গিফারী বলেন, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, এই ৫ জেলায়, ৪ সদস্য (ড্রাইভার সহ ৫জন) বিশিষ্ট ডুবুরী টিম কাজ করে যাচ্ছে। এই ৫ জেলা থেকে মোট ২৮টি ফোন আসে এবং উদ্ধার করি ৩১জন। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের নিকলী, মিঠামইন, অষ্ট্রগ্রাম থেকে ৮টি ফোন পেয়ে উদ্ধার করি ১২ জন, বাকী ৪ থেকে ৫ জন পরবর্তীতে এলাকাবাসীর মাধ্যমে উদ্ধার হয়। তিনি আরো বলেন, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী জেলায় কমপক্ষে ৩সদস্যের একটি টিম থাকলে ভাল হয়। বর্ষায় কিশোরগঞ্জের হাওর ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। সাঁতার না জানায় পানিতে নেমে কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। হাওরে বেড়াতে গেলে লাইফ জ্যাকেট পরার পরামর্শ দেন তিনি। আর সাঁতার জানলেও স্রোতে গোসল করতে না নামাই ভালো।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, হাওরের যেসব জায়গা বিপজ্জনক, সেসব জায়গায় সতর্কতামূলক সাইন বোর্ড স্থাপনের পাশাপাশি নৌকায় ভ্রমণ ও পানিতে গোসলের বিষয়ে কড়াকড়ি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh