রংপুর নগরীতে শারদীয় দুর্গোৎসবের দশমীতে দুর্গার বিদায়ের আগমুহূর্তে পূজামণ্ডপগুলোতে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা। সুন্দর ও মঙ্গলময় আগামীর প্রত্যাশার সঙ্গে জীবনকে রঙের মতো রঙিন করতে সকাল থেকে প্রতিটি পূজামণ্ডপে ছিল সিঁদুর উৎসব। একে অন্যকে লাল রঙের সিঁদুরে রাঙানোসহ ঢাক ঢোলের তালে আনন্দে ভাসছেন। সিঁদুরময় এই আনন্দ উচ্ছ্বাসে শুধু নারীরাই নয়, পূজামণ্ডপগুলো তরুণ-তরুণীদেরও উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
বুধবার (৫ অক্টোবর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রংপুর নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে শারদীয় দুর্গাপূজার মহাদশমীতে সিঁদুর খেলার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। বিদায়ক্ষণে দেবীর আরাধনা শেষে সন্ধ্যা থেকে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবছরের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।
নগরীর উত্তর মুলাটোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নির্মিত উজ্জ্বল সমিতির অস্থায়ী পূজামণ্ডপে বিভিন্ন বয়সী নারীদের উপস্থিতি বর্ণিল উৎসবের রঙ ছড়িয়েছে সিঁদুর খেলা। নতুন সাজ আর সিঁদুরের আলতো ছোঁয়ায় গালে–মুখে লাল রঙের আবরণে অন্যরকম মূহুর্তে মেতে ওঠেন ভক্তরা। সঙ্গে গানের তালে একটু হেলে দুলে উৎসবের আমেজ মন ছুঁয়ে যায়।
মায়ের সঙ্গে পূজামণ্ডপে আসা অনার্সপড়ুয়া পূর্ণিমা মজুমদার শিলা বলেন, এরকম দিনে সিঁদুরের ছোঁয়ায় বেশ ভালো লাগছে। সবার গালে-মুখে সিঁদুরে সিঁদুরে একাকার। এই দিনটার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষায় থাকি। দশমীর আগমুহূর্তে আমাদের এই আনন্দ উচ্ছ্বাসে একটাই চাওয়া আগামীদিনগুলো যেন আরো রঙিন ও স্বপ্নময় হয়ে উঠে।
সবাই যখন সিঁদুর ছোঁয়ায় ব্যস্ত তখন নাচেগানে উচ্ছাস করা পুরুষদের দেখা যায় বেশ উজ্জীবিত। তাদের অনেকের গালে-মুখে সিঁদুরের ছোঁয়া ছিল। সেখানে কথা হয় উজ্জ্বল সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুব্রত কুমার রায় সুমনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সিঁদুর খেলা দুর্গোৎসবের দশমীতে হয়ে থাকে। এটা ভক্তদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কমবেশি সবাই এই দিনটাকে বেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করে আসছে। সকালে শুরু হয়ে দুপুরের মধ্যে বেশির ভাগ পূজামণ্ডপে দেবী বিসর্জনের আগে উৎসবমুখর পরিবেশে এই সিঁদুর খেলা সম্পন্ন হয় থাকে বলে জানান এ সংগঠক।
নগরীর ধর্মসভা, পালপাড়া, গুপ্তপাড়া, নিউ আদর্শপাড়া, মুলাটোল, করুণাময়ী কালীবাড়ি, আনন্দময়ী সেবাশ্রম, জুম্মাপাড়া, আলমনগর স্টেশন, তাজহাটসহ বিভিন্ন পূজামণ্ডপে সিঁদুর উৎসব দেখা যায়। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাথে নেচে-গেয়ে গানের তালে তালে একে অপরকে সিঁদুর মাখানোর মাধ্যমে বিসর্জনের দুঃখ ভুলে অনিন্দ্যসুন্দর আগামীর প্রত্যাশার মেতে উঠেন।
ঐতিহ্যবাহী কালীবাড়ি মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাবন প্রসাদ বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবার দুর্গোৎসব হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল পূজামণ্ডপ। দশমীর দিনে সিঁদুরের ছোঁয়ায় এই উৎসব আরো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমরা ভীষণ আনন্দিত।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রংপুর জেলা সভাপতি সুশান্ত ভৌমিক জানান, বিজয়া দশমীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অন্যরকম আবেগ ও মন খারাপ করা এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কারণ, দশমী মানেই দুর্গা মায়ের ফিরে যাওয়া। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটি বছর। তবে বিসর্জনের আগমুহূর্তে সিঁদুর খেলায় রঙিন দিনের প্রত্যাশায় সবার মিলিত হওয়াটাও ভীষণ আনন্দের।
এদিকে বুধবার সন্ধ্যার পর একযোগে পূজামণ্ডপগুলো থেকে দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গোৎসবের দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন।
এব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরপিএমপি) কমিশনার নুরেআলম মিনা বলেন, বিসর্জনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে সব পূজামণ্ডপে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল। সবার মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
সনাতনী শাস্ত্র অনুযায়ী জানা যায়, এবার দেবীদুর্গা জগতের মঙ্গল কামনায় গজে (হাতি) চড়ে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছেন। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড় বৃষ্টি হবে এবং শস্য ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে স্বর্গে বিদায় নেন নৌকায় চড়ে। যার ফলে জগতের কল্যাণ সাধিত হবে। এ বছর রংপুর জেলায় ৯৩৫টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে শুধু রংপুর মহানগরে রয়েছে ১৫৮টি মণ্ডপ।