টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বসতবাড়ি, মাঠ-রাস্তাঘাট, বীজতলা ও ফসলি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে আছে। মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকা এলাকাগুলোতে মাটির চুলায় রান্না বন্ধ হয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবনে।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকালে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ রোড, সমসেরাবাদ, সদর উপজেলার পার্বতী নগর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রাম বিষ্ণুনগর,কৃষ্ণপুর. বাবুপুর. ওয়াহিদপুর. ৭নং বশিকপুর ইউনিয়ন. ৬নং ভাঙ্গা খা ইউনিয়ন. বটতলী. চন্দ্রগঞ্জ. হাজিরপাড়া. রায়পুর. রামগঞ্জ. লামচরীসহ কমলনগর উপজেলার চরমার্টিন, চরলরেন্স ও চরকালকিনির নাসিরগঞ্জ এলাকায় গিয়ে পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়।
এ ছাড়া ৩/৪ দিন সকাল থেকে পুরো জেলায় হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। গত চার দিনে লক্ষ্মীপুরে ৩১২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে রামগতি উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন।
সরজমিনে পার্বতী নগর ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায় পানিবন্দি সব কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে দেখা যায় উঠানে বন্যার পানি থই থই করছে আর ঘরের ভেতরে অন্ধকার। রামগতি উপজেলা আলেকজান্ডার পানিবন্দি অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে দুঃখ-কষ্টের কথা অনর্গল বলতে থাকেন ঐ এলাকার বাসিন্দারা । এ ছাড়া রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। এর থেকে বাঁচতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নদী তীর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে খেটে খাওয়া নিন্ম আয়ের মানুষগুলো। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পার্বতী নগর ইউনিয়ন সোনাপুর সলিম স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ পানির নিচে ডুবে আছে। বিদ্যালয়ের মাঠে স্থানীয় বাসিন্দাদের বুধবার রাতে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জ. চরবংশী.খাসেরহাট.উত্তর কেরোয়া. দক্ষিণ কেরোয়া গ্রাম পুরোটাই পানির নিচে ডুবে গেছে । মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বৃষ্টি কমলেও বুধ ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
কমল নগর উপজেলার নাসিরগঞ্জ এলাকায় পানিবন্দি নবী উল্লাহ, নিশান উদ্দিন হাওলাদার, আতুরি বেগম, মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় । পানিবন্দি হয়ে অনেকে রান্না করতে পারেননি। দুপুরে শুকনো খাবার খেতে হয়েছে অধিকাংশ পরিবারকে। আবার অনেককে দেখা গেছে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে।
মেঘনাপাড়ের বসবাসরত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন দুইবার নদীতে জোয়ার আসে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি নদী থেকে প্রায় ৩/৪ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত গিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। নদীর কাছাকাছি এলাকার পানি ভাটায় নেমে যায়। কিন্তু নদী থেকে দূরবর্তী এলাকার পানি নামে না। জোয়ার চলে গেলেও জলাবদ্ধতা সেসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে গেছে। বীজতলাসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে রয়েছে। স্থানীয় খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করার কারণেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। এবারের মতো এতো পরিমাণ বৃষ্টি এ অঞ্চলের মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি বলেও জানান স্থানীয় লোকজন।
কামরুল নামে এক বৃদ্ধ বলেন, বিগত সরকার ৩১ শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী তীর রক্ষা বাঁধের বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এমপি ও উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের জোরালো কোনো পদক্ষেপ ছিল না। বেড়িবাঁধ না থাকার কারণেই রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মানুষের ভোগান্তির মূল কারণ
বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
আমেনা বেগম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর সব ডুবে থাকে। এমন অবস্থায় ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। রান্না-বান্না করতে সমস্যা হয়। ছেলে-মেয়ে স্কুল-মাদরাসায় যেতে পারে না।
হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এমরান হোসেন বলেন, পানির তোড়ে গ্রামীণ রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে জোয়ারের পানি ঢুকলেও নামার পথ নেই। পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কালভার্ট নেই। জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। আমরা জোয়ারের ও বন্যার পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। তাই দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলে জোয়ারের পানির কবল থেকে উপকূল রক্ষা পাবে।
সদর উপজেলা পার্বতিনগর সোনাপুর সলিম স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ বলেন, লক্ষ্মীপুর জেলাকে বন্যা থেকে বাঁচাতে এ জেলার অধিকাংশ এলাকা প্রভাবশালীদের কাছে খাল -নালা বেদখল হয়ে আছে। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্থানীয়দের সহযোগিতায় খাল- নালা অপরিকল্পিত বাঁধ দখলমুক্ত করলে এই জেলার বাসিন্দারা উপকৃত হবে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নদী ভাঙন নিয়ে আপাতত কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না—আশা করছি। জিও ব্যাগ ডাম্পিং প্রায় শেষ। ১০২টি প্যাকেজের ৯২টি প্যাকেজের কাজ চলমান রয়েছে। খুব শিগগিরই বাঁধ নির্মাণ ও ব্লক স্থাপন করা হবে। নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।