× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা জামায়াত বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও ঘটনাবহুল ২০২৪ সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

রংপুরে হার্টের রক্তনালী ছিদ্র করে রোগী মারলেন ডাঃ মাহাবুবুর!

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো।

১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:০৭ পিএম । আপডেটঃ ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:১৭ পিএম

ছবিঃ সংগৃহীত

সহকর্মী চিকিৎকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহীন শাহ এমনিভাবে বিশ্বাস করে কার্ডিওলজি বিভাগের সহকর্মী সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মাহাবুবুর রহমানের অধীনে ভর্তি করেন তাঁর আপন খালু রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আফজাল হোসেনকে (৬৫)। স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা আফজাল হোসেনকে এনজিওগ্রাম করে রক্তনালীতে রিং (স্টেন্ট)  লাগাতে গিয়ে তা ছিদ্র করে ফেলেন। 

গত বছরের ৭ নভেম্বর এনজিওগ্রাম করে রিং লাগাতে গিয়ে হার্টের রক্তানালী ছিদ্র হওয়ায় রক্তক্ষরণে কয়েকঘন্টা পরে মারা যান আফজাল হোসেন। এমন ‘ভয়ংকর মৃত্যুর’ বর্ণনা উঠে এসেছে একজন চিকিৎসক এবং ক্যাথল্যাবে (যেখানে রিং পরানো হয়) কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে কথোপকথনে। সেই ডাঃ মাহাবুবুর রহমানের রিং পরানো সম্পর্কিত অডিও ক্লিপ সাংবাদিকের হাতে এসেছে।

ডাক্তার হয়ে হার্টের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন,হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে ‘আতংকিত’ করে তোলেন এমন সব অভিযোগের সঙ্গে আফজাল হোসেনসহ আরেকজন রোগীর মৃত্যুর লিখিত অভিযোগের মুখোমুখি এখন ডাঃ মাহাবুবুর রহমান।

ওই অডিও ক্লিপে একজন চিকিৎসক সিনিয়র ওই স্টাফ নার্সের নিকট জানতে চান কীভাবে ৭ নভেম্বর ডাঃ মাহাবুবুর রহমান অধীনে চিকিৎসারত অবস্থায় আফজাল হোসেন মারা যান। উত্তরে ওই নার্স জানান_`ওইদিন ডাক্তার মাহবুব পাঁচটি এনজিওগ্রাম করার পর দুপুরে পরীক্ষা-নিরিক্ষা ও প্রস্তুতি ছাড়াই আফজাল হোসেনকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে এসে এনজিওগ্রাম করেন। এনজিওগ্রামে হার্টের একটি রক্তনালী সম্পূর্ণভাবে ব্লক ছিল এবং ডাঃ মাহবুব সেটাতে রিং পরানোর জন্য ওইদিন দুপুর দেড়টায় ক্যাথল্যাবে কর্মরত নার্স ও টেকনিশিয়ান খোরশেদকে তাগাদা দেন। ডাঃ মাহাবুবকে সম্পূর্ণভাবে ব্লকড রক্তনালীতে রিং লাগাতে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলে ডাঃ মাহবুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওই নার্সকে ‘বকাঝকা’ করেন। ওই বন্ধ রক্তনালীতে একটার পর একটা রিং লাগানো ওয়্যার ও বেলুন ঢুকিয়ে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ রক্তনালী খুলতে চেষ্টা করেন। ফলে রক্তনালী ফেটে যায়।'

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন কার্ডিওলজিস্ট জানান, রক্তনালী সম্পূর্ণরুপে ব্লক থাকলে অত্যাধুনিক উন্নত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, যেটা রংপুর মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নেই। অথচ ডাঃ মাহাবুব জোর করে রিং ওয়্যার ও বেলুন ঢোকানোর কারণে রক্তনালী ফেটে যায়। এরপর মাহাবুব ক্যাথল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করে রেজিস্ট্রার খাতায় ইংরেজিতে ‘ঈধহপবষষবফ’ লিখে আফজালের মৃত্যুর দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। রেজিস্টার খাতার এই দুইটি কপিও এখন সাংবাদিকদের হাতে। 

ওই নার্স বলেন_পরবর্তীতে ওই রোগীকে সিসিইউতে নিয়ে কোন ধরনের সুরক্ষা ছাড়াই রোগীর হার্টের ভিতর থেকে রক্ত বের করে ওই রোগীর হাতে লাগানো ক্যানোলা দিয়ে সেই রক্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করাতে থাকেন ডা. মাহাবুব। ফলে একপর্যায়ে তিনি মারা যান।

কথোপকথনে ওই নার্সিং কর্মকর্তা বলেন_ ডা. মাহবুব প্রতিটি এনজিওগ্রামে ব্যবহৃত নিডিল, ক্যাথেটার, এক্সটেনশন টিউব তাঁর নিকট থেকে কিনতে বাধ্য করেন এবং পাঁচ-ছয়শত টাকার জিনিস আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেন। প্রতিটি এনজিওগ্রাম থেকে তিনি তিন থেকে চার হাজার টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেন। ওইদিন পাঁচটি এনজিগ্রাম করে বিশ হাজার টাকা অবৈধ আয় করেন।

নার্সিং কর্মকর্তা এক পর্যায়ে ডাঃ মাহাবুবকে ‘কসাই’ বলেও অ্যাখ্যায়িত করেন। ওই নার্স আরো বলেন_প্রতিটি এনজিওগ্রাম করে রোগীকে এনজিওগ্রামের টেবিলে রেখে ডাঃ মাহবুবের ক্যাথল্যাবের ভেতরের নিজের রুমে রোগীর লোককে ডেকে মৃত্যু ভয় দেখিয়ে রিং লাগানোর জন্য আতংকিত করেন। তিনি নিজেই অবৈধভাবে রিং বিক্রি করেন কিন্তু টাকা গ্রহণের রিসিট সরবরাহ করেন না।

উল্লেখ্য, গত ৭ ডিসেম্বর রমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহিন শাহ্;। গত বছরের ৭ নভেম্বর ডা. মাহাবুবের অধীনে রিং পরানোর পর মারা যান ডাঃ শাহিন শাহ’র খালু আফজাল হোসেন (৬৫)। 

অন্যদিকে, ডাঃ মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় স্বামী লাল মিয়া (৫০) মারা যাওয়ার ৮ নভেম্বর আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গুজাপাড়া গ্রামের মোসা. ফরিদা বেগম।

২১ সেপ্টম্বর ডা. মাহাবুবের প্রতারণার শিকার বদরগঞ্জের মাসুমা বেগমের ছেলে মোহা. মশিউর রহমান লিখিত অভিযোগ করেন যে হার্টের রক্তনালীতে ব্লক না থেকেও ব্লক আছে এমন প্রতারণা করার জন্য। ২৩ নভেম্বর গাইবান্ধার ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমানও ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেওয়ার জন্য।

এদিকে ডাঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে গত ৭ ডিসেম্বর তিন সদস্যের ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হরিপদ সরকারকে সভাপতি ও হাসপাতালের উপপরিচালক আ.ম. আখতারুজ্জামানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইদুজ্জামান। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

গত ৮ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় প্রধান ডা. হরিপদ সরকার স্বাক্ষরিত (স্মারক নং-২০২৪/১২/০৮/০১) পত্রে ‘ক্যাথল্যাবে অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংক্রান্ত’ বিষয়ে বক্তব্য ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে ডা. মাহবুবুর রহমানকে লিখিতভাবে তলব করেছেন।

অন্যদিকে হাসপাতালের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও নার্সরা ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি বিক্রির অভিযোগ মৌখিক ভাবে অবগত করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং তদন্ত কার্যক্রম শুরুর পর অবৈধ আয়ের গোমর ফাঁস হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ডাঃ মাহবুবুর রহমান। নিজের দোষ ঢাকতে মরিয়া হয়ে ওঠা এ চিকিৎসক বিভিন্ন মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের ম্যানেজ করার মিশনে ব্যর্থ হন।

এর পরই স্থানীয় ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি গণমাধ্যমের প্রিন্ট ‍ও অনলাইন ভার্সনে ডাঃ মাহবুবুর রহমানের ‘সাফল্য’ তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হাসপাতালের বন্ধ থাকা ক্যাথল্যাবটি মাহবুবুর রহমানের প্রচেষ্টায় চালু এবং হার্টে রিং স্থাপনসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তদন্ত কার্যক্রম চলাকালে তদন্ত প্রভাবিত করার অপচেষ্টা থেকে এমন সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীসহ সচেতন মহল।

এদিকে প্রকাশিত সংবাদটি এই প্রতিবেদকের নজরে আসার পর অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১০ ও ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদটিতে নতুন কোনো তথ্য নেই। বরং আট মাস আগে মার্চ মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ক্যাথল্যাব চালুর সংবাদটি হুবহু প্রকাশ করা হয়। যেখানে শুধু মাত্র পূর্বের পরিচালকের নামের জায়গায় পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে একজন ডাক্তার জানান। সচেতন মহলের দাবি, নিজের অপকর্ম ঢাকতে সাফল্যের ঢোল পেটাতে গিয়েও ভুল করেছেন ডাঃ মাহবুবুর রহমান। এখন প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধি করতেই কী মাহবুবুর রহমান ক্যাথল্যাব চালুর উদ্যোগ নেন? 

অন্যদিকে ডাঃ মাহবুবুর রহমান তার চেম্বারের সামনে বিভিন্ন ডিগ্রি উল্লেখ করে  আগের টাঙ্গানো নেমপ্লেট সরিয়ে নিয়েছেন। সেখানে এখন শুধু নিজের ও পদবি উল্লেখ করে নতুন নেমপ্লেট টাঙ্গানো হয়েছে। হঠাৎ দীর্ঘদিন ধরে টাঙ্গানো নেমপ্লেট পরিবর্তন করায় তার ডিগ্রি নিয়েও নানান প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ রোগী, ভুক্তভোগী ও সচেতন মহলের মাঝে।

এদিকে  দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ও রমেক হাসপাতাল পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে ডাঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বাণিজ্যসহ প্রতারণার একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

যোগাযোগ করা হলে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ডাঃ মাহাবুবুর রহমান বলেন, প্রত্যেকটা রোগীর হার্টে রিং স্থাপনের পর তাকে রিপোর্ট কপি এবং সিডি দেওয়া হয়। সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকে। এর পরও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে এটা দুঃখজনক।

তিনি আরও বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্টে রিং বসানো বা স্থাপন এবং এনজিওগ্রাম খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কম হওয়ায় কিছু সিন্ডিকেট ও কুচক্রী মহল রোগীর স্বজনকে ভুল বুঝিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। তিনি কোনো অর্থনৈতিক লেনদেনের সাথে জড়িত নন বলেও দাবি করেন।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.