ছবিঃ সংবাদ সারাবেলা।
কক্সবাজারের চকরিয়া প্রতিবছরের মতো এবারও ফসলি জমি দখল করে চাষ করা হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক। তামাক আবাদ বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তামাক চাষ বন্ধের ব্যাপারে ফলাফল শূন্য। উল্টো দিন দিন তামাকের আগ্রাসন বাড়ছে। চিকিৎসকদের মতে, তামাক রোপন থেকে শুরু করে পাতা কাটা এবং শুকানো পর্যন্ত এর সকল প্রক্রিয়াতে রয়েছে বিষাক্ত ছোবল।
কৃষকরা ভয়াল এ বিষ সম্পর্কে জানার পরেও বাড়তি লাভের আশায় এসবেই ঝুঁকছে বেশি। এর পরিচর্যায় কৃষকরা নিজেদের পাশাপাশি পরিবারের স্ত্রী ও কোমলমতি শিশুদেরও ব্যবহার করছে। ফলে বাড়ছে ক্যান্সার সহ তামাক জনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তামাক চাষি জানান, এক একর জমি ধান চাষ করলে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হয়।
আর এক একর জমি তামাক চাষ করলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন তামাক কোম্পানি অগ্রিম টাকা ও বিভিন্ন কীটনাশক দিচ্ছে। এজন্য কৃষকরা ধান কিংবা সবজি চাষ না করে তামাক চাষে ঝুঁকছেন। সবজি চাষি সুলতান আহমদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে চকরিয়ার মানিকপুরের মাতামুহুরি নদীর তীরবর্তী এলাকায় শীত মৌসুমে সবজি চাষ হতো।
দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানি চাষিদের সবজির পরিবর্তে তামাক চাষের উদ্ভুদ্ধ করছে। এখন মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় শত শত একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এমনকি তামাক চাষের আগ্রাসন থেকে রেহাই পাচ্ছেনা মাতামুহুরি নদীর দুই তীরের সরকারি খাস জমিও। ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে মরণঘাতী তামাকের।
চলতি বছরে উপজেলার অন্তত আটটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ জমিতে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসন ঘটেছে। ফসলি জমির পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমির খাসজমিতেও তামাক চাষ হয়েছে। কয়েকবছর ধরে তামাক চাষের বিরুদ্ধে উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের চাষীদের নিরুৎসাহিত করতে সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা কোন কাজে আসেনি। অভিযোগ উঠেছে, অসংখ্য তামাক কোম্পানি চাষিদের তামাক পোড়ানোর সরঞ্জাম সরবরাহ এবং দাদন হিসেবে অগ্রিম টাকা দেয়ার প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে নামিয়েছে।
কৃষি জমিতে তামাক আবাদের ফলে চলতি মৌসুমে বোরোর আবাদ ও রবিশস্য উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তামাক চাষের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জোরদারে নিয়োজিত এনজিও সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন খান বলেন, প্রতিবছর চকরিয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ জমিতে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ বেড়ে চলছে।
ফসলি জমিতে তামাক চাষের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমতে থাকায় এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে কৃষি উৎপাদন। তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে খাদ্য উদ্বৃত্ত প্রতিটি জনপদে একসময় চরম খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিবে। এ জন্য তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসনকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নে বনবিভাগের বিপুল জমি দখল করে তামাক চাষের চিত্র উঠে এসেছে। বেশিরভাগ তামাক ক্ষেত এখন রোপন শুরু হয়েছে। কিছুদিন পর চলবে তামাক পোড়ানোর কাজ।
এ লক্ষ্যে তামাক চাষ অধ্যুষিত বনাঞ্চলের আশপাশে ও লোকালয়ে আগেভাগে শতশত তামাক চুল্লীর নির্মাণকাজও শুরু হয়েছে। ওইসব এলাকার গ্রামের ভেতরে বাড়ির আঙ্গিনায় স্থাপন করা হচ্ছে তামাক পোড়ানোর শত শত চুল্লি। তামাক পোড়ানো কাজ শুরু হলে চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে গ্রামের বাড়িতে ঢুকবে। এতে গ্রামের মানুষ চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েবে।
এ বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিবে। তামাকের কটু গন্ধে ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়বে। তামাক রোপন, পাতা কাটা ও পোড়ানোর কাজে চাষিরা নারী ও শিশুদের ব্যবহার করছে। নারী-শিশুদের কম মজুরি দিতে হয় তাই তাদের খাটায় চাষিরা। এতে শিশুরা প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ছে। পাশাপাশি বসতবাড়িতে অগ্নিকান্ডের প্রবণতাও বাড়ছে। সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে কাঠ পাচারকারীচক্র তামাক পোড়ানোর জন্য বনবিভাগের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে বনজ সম্পদ উজাড় করে চলছে।
এ অবস্থার কারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড় এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে। সচেতনমহলের অভিমত, নাগরিক সচেতনায় প্রশাসনিক এত আয়োজনের পরও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ফসলি জমির পাশাপাশি সংরিক্ষত বনাঞ্চল এবং মাতামুহুরী নদীর তীরে তামাকের আগ্রাসন চলছে। সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, তামাক চাষ কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। চাষিরা বেশিভাগ গরীব,তাঁরা দাদনদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এতে তারা তামাক চাষ করে লাভবানও হচ্ছে না।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস.এম. নাসিম হোসেন বলেন, তামাক চাষের কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন এলাকায় মাঠ বৈঠকের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এতে বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছরে অনেকাংশ জমিতে তামাক চাষ হয়নি। তারা এসব জমিতে সবজি, সরিষা ও বাদাম চাষ করেছে। চাষিরা একটু সচেতন হলেই পরিবেশ বিধ্বংসী এই তামাক চাষ বন্ধ করা সম্ভব। তামাক চাষ যদি বন্ধ করা না হয় তাহলে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি জানান।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh