পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের মোহিনী মোহন দাস লেনে অবস্থিত জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহার ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলাবাস ভবন । নান্দনিক কারুকার্যখচিত ব্রিটিশ আমলের প্রাসাদটি বর্তমানে কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জরাজীর্ণ ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ সংস্কার না হওয়ায় পলেস্তারা খসে পড়ছে, জীবনঝুঁকি নিয়ে ছাত্রাবাসে বাস করছে শিক্ষার্থীরা।
ফরাশগঞ্জ বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তরে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। আঠারো শতকে নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের অনুমতিক্রমে ফরাসি বণিকরা আহসান মঞ্জিল প্রাসাদের নিকটে ফরাশগঞ্জে বাণিজ্যের জন্য একটি কুঠি স্থাপন করেছিলেন। ফরাসিরা এখানে হলুদ, আদা, রসুন ও মরিচ পাইকারি বিক্রির জন্য এই বাজার প্রতিষ্ঠা করে, যা পরে মশলাপতির পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ফরাশগঞ্জে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ রয়েছে, যার মধ্যে মোহিনী মোহন দাস লেনে অবস্থিত মঙ্গলাবাস অন্যতম। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই প্রাসাদটি তাঁর অপূর্ব নান্দনিক কারুকার্যের জন্য পরিচিত এবং দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটির সঠিক কোন ইতিহাস জানা যায়নি । তবে ধারণা করা হয় উনিশ শতকের শেষার্ধে ভবনটি নির্মিত হয়েছিল । ইতিহাস গবেষকদের মতে, ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটির মালিক ছিলেন জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহা । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়ে এই সম্পত্তি ফেলে তিনি কলকাতায় চলে যান।
মুক্তিযুদ্ধের কিছু পূর্বে থেকে মঙ্গলাবাস ভবনটি কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এই কলেজের শিক্ষার্থী শামসুল আলমের নামেই ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে 'শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস'। এই ছাত্রাবাসে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বাস করে।
ঐতিহ্যবাহী এই ভবনে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে প্রধান ফটকে বড় করে লেখা ‘মুক্তি খেলাঘর আসর ’ । জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালের ১ লা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় এই ক্লাবটি। ভবনটির পাশেই অবস্থিত মুক্তি খেলাঘর আসরের অফিস কক্ষ , যেখান থেকে পরিচালিত হয় ক্লাবটির বিভিন্ন কার্যক্রম। ভবনের সামনেই দিনভর বিভিন্ন খেলাধুলা ও আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে স্থানীয় শিশু-কিশোররা। মঙ্গলাবাস ভবনের পাশেই রয়েছে ক্লাবটির মাঠ।
মঙ্গলাবাস ভবনটি তিনতলা হলেও যা বর্তমান নির্মাণশৈলীর পাঁচতলা ভবনের সামন। এই ভবনটিতে মোট ৩৫টি কক্ষ রয়েছে । এই প্রাসাদটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এক কক্ষ দিয়ে প্রবেশ করে সব কক্ষে যাওয়া যায়।
ব্রিটিশ আমলের এই প্রাসাদের দক্ষিণ পাশে এখনো সেই আমলের একটি কুয়া দৃশ্যমান। এই প্রাসাদে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা এখনও বালতিতে দড়ি বেঁধে কুয়া থেকে পানি তুলে গোসল করে। আধুনিক যুগে এসেও বালতির হাতলে দড়ি বেঁধে কুয়া থেকে পানি তুলার দৃশ্য দেখার মতো।
প্রাচীন এই ভবনটির অভ্যন্তরে কুয়াটির পাশেই একটি বড় আম গাছ দাঁড়িয়ে আছে । প্রভাতে নব উদিত সূর্যের আলো যখন গাছের ডালপালার ফাঁক গলে ছাদে এসে পরে তখনই দলবেঁধে আসে বানরের দল । আধুনিকতার স্পর্শে গ্রাম-গঞ্জে বিলুপ্তির পথে বানর । তবে মঙ্গলাবাসে এখনও দেখা মেলে বানরের অপূর্ব দুরন্তপনার দৃশ্য, যা আকর্ষণ করে প্রতিটি মানুষকে।
শতবর্ষী এই ভবনটির জরাজীর্ণ দেয়াল দূর থেকে দেখলে মনে হয় এটি যেন কোন ভূতুড়ে বাড়ি। ভবনটির কাছে এগিয়ে গেলে দেখা যায় ফাটল ধরা দেয়াল, ছাল ওঠা জীর্ণ দরজা-জানলা, সিঁড়িগুলোতে ধুলার আবরণ , দেয়ালে শ্যাওলা জমে ছোট ছোট লতা-পাতা জন্মে আছে।
প্রাচীন এই ভবনের দেয়ালের আস্তর খসে পড়ে ইট বেরিয়ে আছে ।বেশ কিছু কক্ষের পলেস্তারা খসে পড়ে ,একটি কক্ষ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে । বর্ষার সময় ছাদ ও দেয়াল চুইয়ে চুইয়ে প্রায় প্রতিটি কক্ষেই পানি পড়ে এবং ব্যবহার উপযোগী কোন শৌচাগার ও গোসলখানা না থাকায় শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগে।
এছাড়াও, ছাত্রাবাসে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত কোনো ক্যান্টিন নেই। খাবারের জন্য ডাইনিং ব্যবস্থা থাকলেও, সেখানে স্বাস্থ্যকর ও মানসম্মত খাবারের অভাব প্রকট। রমজানকে সামনে রেখে খাবারের দাম বাড়ানো হলেও এর মানের কোনো উন্নতি হয়নি।
কালের আবর্তে বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে । জরাজীর্ণ মঙ্গলাবাস এমনি এক ঐতিহ্যবাহী স্থান, যেখানে ভ্রমণ করতে আসে দেশ-বিদেশি অনেক দর্শনার্থী । তাই ভবনটির ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্ব সংরক্ষণ করে সংস্কার এবং ইতিহাস পাঠক ও দর্শনার্থীদের জন্য যথার্থ ইতিহাস দৃশ্যমান রাখা জরুরি।
ছাত্রাবাসে অবস্থানরত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মনিরুজ্জামান মারুফ বলেন, ছাত্রাবাসে থাকার পরিবেশ নেই বললেই চলে। ছাত্রাবাসের ওয়াশরুমের দুরবস্থা , বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব এবং ডাইনিংয়ে মানসম্মত খাবারের সংকটসহ নানান সমস্যায় আমরা ভুগছি। খাবার রান্নার স্থান দেখলে মনে হবে এটি যেন রোগ জীবাণু তৈরির কারখানা।
মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন নামে আরেক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন ,পৃথিবীর বুকে আমরাই বোধহয় সবচেয়ে অবহেলিত আবাসিক শিক্ষার্থী। রমজান সংযম ও ফজিলতের মাস এমন বরকতময় মাসে এসেও আমরা সুবিধা বঞ্চিত। সেহরিতে মানসম্মত খাবার না পেয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।