× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা জামায়াত বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ট্যাক্সিডার্মির ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের জুয়েল রানার সফলতা

মোঃ শহিদুল ইসয়াম, ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি।

১৬ মার্চ ২০২৫, ১৬:০০ পিএম

ছবিঃ সংবাদ সারাবেলা।

ট্যাক্সিডার্মি হলো এমন একটি বিশেষ কৌশল, যেখানে মৃত প্রাণীর দেহাবশেষকে এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যেন তা জীবন্ত অবস্থার মতো দেখায়। গ্রিক শব্দ ‘ট্যাক্সি’ (সাজানো) এবং ‘ডার্মি’ (চামড়া) মিলে এই শব্দের উৎপত্তি, যার সহজ অর্থ ‘চামড়া সাজানো’। এই প্রক্রিয়ায় মৃত প্রাণীর ত্বক ও অন্যান্য অংশ রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে একটি কৃত্রিম কাঠামোতে স্থাপন করা হয়। এ কাজটি করা হয় স্টাফিং পদ্ধতিতে।

ট্যাক্সিডার্মির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় ফারাওদের মমির সঙ্গে তাদের পোষা প্রাণী ও পাখির নমুনা পাওয়া গেছে। তবে আধুনিক ট্যাক্সিডার্মির বিকাশ ঘটে উনিশ শতকে, ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে। এই সময়কে ট্যাক্সিডার্মির স্বর্ণযুগ বলা হয়।

ট্যাক্সিডার্মির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। ট্যাক্সিডার্মিস্ট যে প্রাণীটি সংরক্ষণ করবেন, সেটির অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি সম্পর্কে তার বিশদ জ্ঞান থাকতে হবে। প্রথমে মৃত প্রাণীটির ত্বক ও অন্যান্য অংশ সাবধানে অপসারণ করা হয়। তারপর, ত্বকটিকে জীবাণুমুক্ত করে এবং রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর, প্রাণীর শারীরস্থানের উপর ভিত্তি করে একটি কৃত্রিম কাঠামো তৈরি করা হয়, যার উপর প্রক্রিয়াজাত ত্বক স্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশে ট্যাক্সিডার্মির ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের জুয়েল রানা এক উজ্জ্বল নাম। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরে কিউরেটর হিসেবে কর্মরত আছেন এবং আধুনিক ট্যাক্সিডার্মির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। জুয়েল রানা বাংলাদেশে প্রথম নীল গাই ও লোনা পানির কুমিরের ট্যাক্সিডার্মি করেছেন।

২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরে সহকারী কিউরেটর হিসেবে যোগদান করেন তিনি। তৎকালীন কিউরেটর আনন্দ কুমার দাশের কাছে ট্যাক্সিডার্মির প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর, ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে একটি স্বল্পমেয়াদী কোর্স করেন। তিনি অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাশ, ড. শওকত ইমাম খান এবং মো. দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকেও ট্যাক্সিডার্মি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ২০১৪ সালে কিউরেটর পদে পদোন্নতি হয় তার।

জুয়েল রানা নিজে প্রথম স্টাফিং করেছিলেন একটি শঙ্খচিলের; কিন্তু প্রাণীটির পা উল্টো হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে প্রথম নীল গাই ও লোনা পানির কুমিরের ট্যাক্সিডার্মি করেছেন তিনি। নীল গাই ১৯৪০ সালে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তার সংরক্ষিত নীল গাইটি পঞ্চগড়ের আটোয়ারি থেকে পাওয়া গিয়েছে। এটি সম্ভবত সীমান্ত পার হয়ে এসেছিল, স্থানীয়রা একে পিটিয়ে মেরেছে। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে জুয়েল ও তার সহকর্মীদের টানা চার দিন সময় লেগেছিল। বর্তমানে এটি গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জুয়েল মৃত প্রাণী সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ বায়োডায়ভার্সিটি কনজারভেশন ফেডারেশন (বিবিসিএফ) নামক নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছেন, যেখানে ২০০টিরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যুক্ত আছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোথায় কোন প্রাণী মারা যাচ্ছে এবং কীভাবে মারা যাচ্ছে, তার খবর দ্রুত জানা যায়।

বঙ্গবন্ধু সেতু জাদুঘরে প্রায় ২৯ বছর ধরে বিভিন্ন মৃত প্রাণী সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই প্রাণীগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক কারণে মারা যায়, যেমন অসুস্থতা বা বার্ধক্য। আবার কিছু প্রাণী মানুষের কারণে মারা যায়, যেমন শিকার বা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। সাপ, বনবিড়াল, নীলগাই, চিতাবাঘ, মেছোবিড়ালের মতো প্রাণীগুলো এভাবেই মারা যায়। আবার কিছু প্রাণী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যায়।

বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে এমন হনুমান, স্থানীয় লোকজন পিটিয়ে মেরেছে এমন মেছোবাঘেরও ট্যাক্সিডার্মি আছে এই জাদুঘরে। এছাড়াও রয়েছে পাখির ১৩৮টি প্রজাতি, যার মধ্যে প্যাঁচা, হুদহুদ, তিলে ঈগল, ফিশ ঈগল, পালাস ঈগলের মতো পাখিও আছে। উভচর প্রাণীর ৯টি প্রজাতি, মিঠা ও সামুদ্রিক মাছের ২৭৫টি প্রজাতি, স্তন্যপায়ী প্রাণীর ৩৩টি প্রজাতি এবং সরীসৃপ ৩২টি প্রজাতি আছে। সেইসাথে, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপকরণ, সেতু নির্মাণের তথ্য, নকশাসহ আট শতাধিক আলোকচিত্রও রয়েছে। সব মিলিয়ে জাদুঘরের সংগ্রহে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি নমুনা রয়েছে।

জুয়েল মৃত প্রাণী স্টাফিংয়ের শুরুতে মৃত প্রাণীর বয়স ও মৃত্যুর কারণ জেনে নেন, তারপর শরীরের মাপ ও হাড়ের গঠন পরীক্ষা করেন। চামড়া ছাড়িয়ে চর্বি পরিষ্কার করে লবণে সংরক্ষণ করেন। এরপর ফোম, তুলা, রেজিন দিয়ে কৃত্রিম কাঠামো বানান। কয়েকদিন পর রাসায়নিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে কাঠামোতে স্থাপন করেন। মুখ তৈরি করা কঠিন, বিশেষ করে প্যাঁচার মুখ আসল খুলির ওপর বসাতে হয়। স্টাফিংয়ের আগে জীবাণুনাশক ব্যবস্থা ও র‍্যাবিস টিকা নেওয়া জরুরি। চামড়া ছাড়ানোর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়।

স্টাফিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়, যেমন— হেয়ার ড্রায়ার, সার্জিকাল যন্ত্রপাতি, হাতুড়ি, করাত, মেজারমেন্ট টেপ, গ্লু-স্টিক, প্লায়ার্স, তুলি, ব্রাশ, মাটি, রং ইত্যাদি। পাখির ক্ষেত্রে পালক বিন্যাস ও রং লেপনের জন্য বিশেষ যত্ন নিতে হয়।

জুয়েল রানা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সহযোগিতা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বন বিভাগের প্রাণী জাদুঘর, সুন্দরবনের করমজল ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, জাতীয় চিড়িয়াখানার জাদুঘর, সরকারি সা'দত কলেজ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কলেজ, সরকারি তিতুমির কলেজ, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ এবং বন বিভাগের জয়মনি টাইগার হাউজ। এ পর্যন্ত ৫০০ প্রাণীর স্টাফিং করেছেন তিনি।

ট্যাক্সিডার্মি একটি কারিগরি দক্ষতার ব্যাপার। তবে, বিজ্ঞানমনস্ক না হলে এই কাজে সাফল্য পাওয়া যায় না। একটি বড় প্রাণীর সংরক্ষণে ট্যাক্সিডার্মিস্টকে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিতে হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে ট্যাক্সিডার্মি নিয়ে উচ্চতর অধ্যয়নের সুযোগ আছে। সেখানে অনেকে স্টাফিংকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। জার্মানিতে ট্যাক্সিডার্মির প্রতিযোগিতা হয়। বর্তমান বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত ট্যাক্সিডার্মিস্টের সংখ্যা মাত্র তিন জন। জুয়েল রানার মতো দক্ষ ট্যাক্সিডার্মিস্টদের প্রচেষ্টায় দেশে এই শিল্পটির বিকাশ ঘটুক, এই আমাদের প্রত্যাশা।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.