খুব ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল মোর্শেদা বেগমের। তখন সংসারে চরম অভাব। সেই সময় কাজের সন্ধানে স্বামী জাভেদ আলীর সাথে টাঙ্গাইলে চলে যান। সেখানে একটি টাওয়াল ফ্যাক্টরিতে কাজ করে কোনরকম জীবন যাপন করেন। ফ্যাক্টরিতেই পরিচয় হয় সহকর্মী কমলা বেগমের সাথে। কাজের ফাঁকে তার সাথে গড়ে উঠে সখ্যতা। রাতে যখন বাড়ি ফেরে মোর্শেদা তারপর কমলা বেগমের টুপি তৈরির কাজ দেখে দেখে রপ্ত করে কলা-কৌশল। দিনে ফ্যাক্টরির কাজ আর রাতে টুপি বানানো। অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করে সে। প্রথম টুপি তৈরি করে মজুরি পান ২শ৮০ টাকা। পরে তার নিখুঁত কাজ দেখে মুগ্ধ হন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা।
তাকে ১৫ হাজার টাকায় ৫০টি টুপির অর্ডার দেয় ঐ বেসরকারি সংস্থাঠ কর্মকতার্। এরপর মোর্শেদা বেগম নিজ গ্রামে ফিরে প্রথমে এলাকার অসহায় বিধবা ৭ জন নারীকে নিয়ে শুরু করে দারিদ্র্য জয়ের সংগ্রাম। তারপরে তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। হাতে বানানো টুপি তৈরি করে এখন সে লাখোপতি। বর্তমানে তার সাথে ৬ হাজার নারী কাজ করছেন। মোর্শেদা বেগম নিজ গ্রাম পাতিলাপুরের নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন নাই আশপাশে প্রায় ৪০-৫০ টি গ্রামের নারীদের কর্মসংস্থান তৈরির ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন বয়সী নারীর পাশাপাশি পুরুষরাও টুপি তৈরীর কাজ করছে।
মোর্শেদা বেগম জানান, ফেনীর দুজন ব্যবসায়ীর কাছে হাতের কাজের নকশা করা টুপি বিক্রি করেন। আর এই টুপি মধ্যপ্রাচ্যের বাহারাইন, সৌদি আরব, দুবাই কুয়েত সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়। ওই ব্যবসায়ীরা তার কাছে রেশমা সরবরাহ করেন। এরপর তিনি স্থানীয় মহিলাদের সাথে সুঁই সুতা দিয়ে তৈরি করে নানা ধরনের নকশাখচিত টুপি। টুপি তৈরির দেখভাল করতে বিভিন্ন গ্রামে ১৫ জন সুপার ভাইজার নিয়োগ দিয়েছেন। হাতে বানানো প্রতিটি টুপি তৈরির জন্য নারীরা পারিশ্রমিক পায় ৪শ থেকে-৫শ টাকা। সুই সুতার খরচ ২শথেকে২শ৫০ টাকা। প্রতি টুপিতে মোর্শেদা কমিশন পায় ১শথেকে ১শ২০ টাকা । প্রতি মাসে ২থেকে৩ হাজার টুপি বিক্রি করে সে।
মোরশেদা আরও জানান টুপি সেলাই করেই আমার দু মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সংসারে উন্নতি করেছি। এবং ওমরা হজও পালন করেছি। আর যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এলাকার মানুষের উন্নয়ন করবো। এ জীবনে আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তিনি জানান শুরুর দিকে বিসিকের সহয়োগীতা চেয়েছিলাম কিন্তু বিসিক কর্মর্তারা তাকে কোন পাত্তাই দেয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে টুপি তৈরির পরিধি আরো বাড়াতে পারবে বলে আশা করেন। গ্রামে হস্তশিল্পের প্রসার বাড়বে।
কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি টুপি মধ্য প্রাচ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। বাহারি রঙের সুতা আর রেশমার উপরে আঁকা বিভিন্ন ডিজাইনে বানানো টুপির চাহিদা বেড়েই চলছে। এই টুপি তৈরি করে এখানকার হাজারো নারীদের হয়েছে কর্মসংস্থান, সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় স্থানীয় নারীদের কাছে মোর্শেদা আপা নামে খুব জনপ্রিয়। তার পরিচিতি শুধু নিজ এলাকায় নয় আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলার মহিলাদের মাঝেও রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার পাতিলাপুর গ্রামে মোর্শেদার বাড়ি। নিপুণ হস্তশিল্প সম্ভার নামে তার প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় কলি বেগম জানান, চার বছর আগে মোর্শেদা আপার কাছ প্রশিক্ষণ নিয়ে টুপি তৈরির কাজ শুরু করি। সংসারের কাজের পাশাপাশি টুপি তৈরীর আয়ে সংসার স্বচ্ছল হয়েছে। এখন তার আর অভাব নেই। শিক্ষার্থী মোছা. লায়লা খাতুন জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি আমি টুপি তৈরি কাজ করি। এখান থেকে যা উপার্জন করি লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করছি। শুধু আমি না আমার মত বিভিন্ন বয়সের নারীরা এখানে কাজ করে। সাতদরগাহ গ্রামের ময়না জানায়, সারা বছর আমরা টুপি তৈরির কাজ করি। বিশেষ করে রমজান মাস ও কোরবানি ঈদে সময় টুপির চাহিদা বেশি থাকে। এসময় টুপি তৈরী করে জনপ্রতি সকলে ৮থেকে ৯হাজার আয় করে।
কুড়িগ্রাম বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ জোনায়েদ জানান, পাতিলাপুর গ্রামের নারী উদ্যোক্তা মোর্শেদা বেগমের টুপি মধ্য প্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এটি কুড়িগ্রাম জেলার গৌরবের। হাজার হাজার নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন তিনি। সরকারি কোন প্রশিক্ষণ, আর্থিক ঋন অথবা তৈরি টুপির বাজারজাতকরণে কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প মোর্শেদা বেগমকে সহযোগিতা করবে।