সরাইল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বুকচিরে চলছে মেঘনার স্রোত। সেই স্রোতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, পাকা রাস্তা, মসজিদ-মন্দিরসহ মানুষের জীবনের শত বছরের স্মৃতি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার মেঘনা নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো যেন নিঃশব্দ এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধ মানুষ বনাম নদী। আর এই যুদ্ধে প্রতিদিন হেরে যাচ্ছে মানুষ।
সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ, শাহবাজপুর, চুন্টা, পানিশ্বর, অরুয়াইল, নোয়াগাঁও ও পাকশিমুল ইউনিয়নের কয়েক ডজন গ্রাম ইতোমধ্যেই নদীর গর্ভে হারিয়ে গেছে বা হুমকির মুখে রয়েছে। অনেক জায়গায় নদীর তীরের পাকা রাস্তা ভেঙে পড়েছে, ফাটল ধরেছে সেতুতে, বালুর বস্তা ফেলে সাময়িকভাবে রক্ষা করার চেষ্টা চলছে কিন্তু প্রকৃতির সামনে তা যেন খুবই তুচ্ছ।
স্থানীয় বাসিন্দা মালেক বলেন, “আমার বাবা এই ঘরে জন্মেছিলেন। আমিও এই ঘরেই বড় হয়েছি। এখন সেই ঘরের একটুকরো মাটি খুঁজে পাচ্ছি না। চোখের সামনে সব চলে গেল নদীর পেটে।”
গত এক মাসেই শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউবা রাস্তার পাশে, কেউ স্কুলঘরে মাথা গোঁজার চেষ্টা করছে।
ভাঙন প্রতিরোধে কিছু জায়গায় জিও ব্যাগ ফেলা হলেও তা কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বহুবার অভিযোগ জানানো হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা উদ্যোগ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, “আমরা ভাঙন রোধে ঊর্ধ্বতন মহলে বারবার জানাচ্ছি। জরুরি কিছু এলাকায় কাজ হচ্ছে, তবে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় বড় পরিসরে টেকসই বাঁধ নির্মাণ ছাড়া উপায় নেই।”
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, শাহবাজপুর-নাসিরনগর সংযোগ সড়ক ও ব্রিজ বর্তমানে সরাসরি হুমকির মুখে রয়েছে। কয়েকশ শিক্ষার্থী প্রতিদিন যাতায়াত করে এই সড়ক দিয়ে। ভেঙে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে পুরো অঞ্চল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরাইলসহ আশপাশের নদী ভাঙন প্রবণ এলাকায় আধুনিক নদীশাসন ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই। প্রতিবার বর্ষা মৌসুমে এমন দুর্ভোগ মেনে নেওয়া মানেই শুধু জনসম্পদ নয়, জাতীয় সম্পদেরও অপচয়।
সরাইলের মেঘনা এখন শুধু নদী নয়, তা যেন এক গিলে খাওয়া দৈত্যে পরিণত হয়েছে। এই দৈত্যকে রুখতে হলে শুধু স্থানীয় প্রশাসন নয়, দরকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ, বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবসম্মত প্রকল্প বাস্তবায়ন। না হলে, আগামী প্রজন্মের কাছে হয়তো শুধু গল্প হয়ে থাকবে এসব গ্রামের নাম।