রামগড় উপজেলার শহর বা সড়কঘেঁষা জনপদ পেরিয়ে যখন কেউ পাহাড়ি গহীনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন এক ভিন্ন জীবনের মুখোমুখি হতে হয়। এখানে রাজনীতি, উন্নয়ন কিংবা সভ্যতার আলো অনেকটাই অস্পষ্ট। পথের ধার ঘেঁষে থাকা কাঠের বাড়ি, বাঁশ-ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর আর মাটি-কাদা পেরোনো পথ।
চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা এই তিনটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী রামগড়ের অভ্যন্তরীণ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করেন। তাঁদের জীবনজুড়ে রয়েছে জুমচাষ, পারিবারিক সহযোগিতা, লোকজ উৎসব এবং প্রকৃতিনির্ভর এক জীবনব্যবস্থা। সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলো পাহাড়ে বেরিয়ে পড়ে। তাদের অধিকাংশই জুমচাষে জড়িত, যেখানে পাহাড় কেটে জমি তৈরি করে একাধিক ফসল চাষ করা হয়, বিশেষত ধান, আদা, হলুদ, কচু, চালকুমড়া, মরিচ ও কাঁচা ফলমূল।
জুমচাষ শুধু কৃষির মাধ্যম নয় এটি একটি সংস্কৃতিও। জুম চাষের শুরুতে বিশেষ ধর্মীয় প্রার্থনা হয়, পাহাড়ের দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য উৎসব পালন করা হয়। মেয়েরা এই চাষে পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে কাজ করেন। পাহাড়ি নারীরা সকালে বের হন কাঁধে ঝুঁলি নিয়ে, ফিরে আসেন ঘাম ও ধূলোমাখা শরীরে, কিন্তু তৃপ্ত মুখে। এই শ্রমজীবনেই তাদের শক্তি, আত্মবিশ্বাস ও পরিচয় গড়ে ওঠে।
তবে এই সুন্দর জীবনের মধ্যে রয়েছে গভীর বঞ্চনার বাস্তবতা। দুর্গম এলাকার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র অধিকাংশ সময় পৌঁছায় না। যেসব স্কুল রয়েছে, সেখানে শিক্ষক থাকেন না, পাঠদান নিয়মিত নয়। অনেক শিশুই স্কুল ছাড়ে মাঝপথেই। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই চিত্র—প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে রামগড় সদর আসতে হয়। জরুরি চিকিৎসায় অনেক সময় প্রাণহানি ঘটে, যা নিয়তির মতো মেনে নিতে হয়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধর্ম ও পোশাকেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। চাকমারা সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, তাদের ভাষা ও লিপি পৃথক। ত্রিপুরারা পালন করেন গরিয়া উৎসব, মারমারা বৌদ্ধধর্মীয় রীতিতে বিশাখা পূর্ণিমা উদযাপন করেন। পাহাড়ি মেয়েদের নিজস্ব তাঁত রয়েছে—তাঁরা নিজেরাই কাপড় বোনেন, পরিধান করেন ঐতিহ্যবাহী রঙিন পরিধেয়। এগুলো শুধু সাংস্কৃতিক উপাদান নয়, বরং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পাহাড়ি অঞ্চল এখনো প্রান্তিক। উন্নয়ন মূলত কাগজে, সরকারি সেবা পৌঁছে না সময়মতো, আর স্থানীয় প্রশাসনও প্রায়শ অনুপস্থিত থাকে দুর্গম অঞ্চলে। তদারকি না থাকায় মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্কেও ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।এই জনপদে সম্ভাবনার অভাব নেই—জলবায়ু, মাটি, শ্রমশক্তি, সংস্কৃতি ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে।
রামগড়ের পাহাড়ি গহীন তাই একদিকে শিকড়, অন্যদিকে সম্ভাবনার বীজ। এখানে জীবন সহজ নয়, কিন্তু প্রাণবন্ত। এখানে আত্মমর্যাদা অটুট। এখানেই লুকিয়ে আছে একটি মানবিক বাংলাদেশের অন্তর্লীন ছবি।