ফেনীর মুহুরী নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা ইট, লোহা আর সিমেন্টের অবকাঠামোটি আজ আর কেবলই একটি সেতু নয়। ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মহামায়া সেতু এখন রূপ নিয়েছে এক প্রাচীন স্বপ্নের বাস্তবতায় এবং আধুনিক পর্যটন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। জানা যায়,দূর্ভোগ পেরিয়ে যোগাযোগ, জীবনমান ও পর্যটনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এই ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার মোহনায় নির্মিত মহামায়া সেতু ।
দীর্ঘদিন ধরে দুই পাড়ের মানুষ অপেক্ষা করছিলেন এমন এক স্বপ্ন বাস্তবায়নের, যা একদিকে বদলে দেবে জীবনযাত্রা, অন্যদিকে খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। ৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫.৫০ মিটার প্রস্থের এই সেতুটি এখন কেবল যাতায়াতের জন্য নয়, রূপ নিচ্ছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে।
মহামায়া ইউনিয়নের মাটিয়াগোদা এবং পাঠাননগরের গতিয়া সোনাপুর ও ফুলগাজীর শ্রীচন্দ্রপুর – এ তিন অঞ্চলের মানুষ আগে নদীর কারণে ছিল বিচ্ছিন্ন। আত্মীয়তার সম্পর্কেও ছিল দ্বিধা, কারণ ছিল দুর্ভোগপূর্ণ পারাপার। সেই শত বছরের দুর্ভোগ ঘুচিয়ে দিয়েছে এই সেতু।
এখন স্রেফ মিনিটখানেকেই পেরিয়ে যাওয়া যায় দুই পাড়। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে মনোভাব, জীবনধারা। এখন দুই পাড়ের মানুষ একসূত্রে গাঁথা, যেন এক প্রাণ এক আবেগ।
সেতুকে ঘিরে বেড়ে উঠছে পর্যটন শিল্প।সেতুর সৌন্দর্য, মুহুরী নদীর শান্ত জলধারা আর চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ মিলিয়ে মহামায়া এখন এক নতুন পর্যটন গন্তব্য। ছুটির দিনে কিংবা বিকেল বেলা প্রতিদিন পরিবার-পরিজন নিয়ে জেলা,উপজেলা সহ বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। অনেকে নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছেন, কেউ আবার ছবি তুলছেন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে।ইতোমধ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে মহামায়া ব্রিজ এলাকায় পর্যটন স্পট নির্মাণের।
সেতুটি এখন শুধুই একটি অবকাঠামো নয়, একটি অনুভবের নাম – যেখানে প্রকৃতি ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে গড়ে উঠছে মানুষের মিলনমেলা।
নৌকা নির্ভর যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে আগে এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে হতো ঘুরাপথে। এখন সেই দিন অতীত। সেতু হওয়ার ফলে ছাগলনাইয়া, ফেনী, বাংলাবাজার, ফুলগাজী,জিএমহাট ও চাঁদগাজীর মধ্যে সহজেই পরিবহন করা যাচ্ছে ধান, সরিষা, ডাল, সবজি। এতে পরিবহন খরচ কমেছে, সময় বেঁচেছে, লাভ বেড়েছে।এমনকি জমির দামও বেড়েছে আশেপাশের এলাকায়।
সেতুটি নির্মিত হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে। নির্মাণ শুরু হয় ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর, শেষ হয় ২০২১ সালে। স্থানীয় এক এলাকাবাসী বলেন, “এই সেতু শুধু একটি যাতায়াত মাধ্যম নয়, এটি যুগের পর যুগের অবহেলিত মানুষের স্বপ্নের প্রতীক।
পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য সেতুর পাশে স্থানীয় সাংবাদিক এবিএম নিজাম উদ্দিন একটি পাঠাগার নির্মাণ করেছেন।নির্মাণ করেছেন একটি গণশৌচাগার এবং নির্মাণ করছেন একটি জামে মসজিদ।
এ সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আর্থ সামাজিক সকল ক্ষেত্রে অনেক উন্নত হয়েছে। এছাড়াও এটি একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, সেতুটিকে ঘিরে একটি পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হোক। নদীর পাড়ে বসার ব্যবস্থা, নৌকা ভ্রমণ ঘাট, শিশুদের খেলার জায়গা এবং স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকানগুলো গড়ে উঠলে এখানে পর্যটনের বিশাল সুযোগ তৈরি হবে।মহামায়া সেতু এখন আর কেবল যোগাযোগের সেতু নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের মিলনের প্রতীক। এর সৌন্দর্য ও গুরুত্ব যেন হারিয়ে না যায় দৈনন্দিনতার ভিড়ে—এমনটাই চায় স্থানীয়রা। ঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হয়ে উঠতে পারে ফেনী জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।