রাজশাহী নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়াও পাড়া মহল্লা ও অলিগলি দখলে নিয়েছে হাজার হাজার পোস্টার-ব্যানার। দিন যতই যাচ্ছে সেগুলোর সংখ্যাও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি সহ নগরের স্বাভাবিক সৌন্দর্যে বিঘ্ন ঘটছে প্রচার উপকরণগুলোর জন্য। কারণে অকারণে মাসের পর মাস সেগুলো সাঁটিয়ে ও ঝুঁলিয়ে রাখার প্রবণতা যেনো বেড়েই চলেছে। বাদ পড়েনি সরকারি দপ্তরের একাংশ ব্যবহারেও।
নিজেদের প্রচার-প্রচারণার স্বার্থে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি কার্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের ভেতরেও পোতা হয়েছে বাঁশের ফরমেট দিয়ে তৈরি বিশালাকার ব্যানার। শুধু নগরীর সৌন্দর্যই বিনষ্ট করা হচ্ছেনা; সরকারি দপ্তরগুলোর বহিরাবরণের সৌন্দর্যও নষ্টা করা হচ্ছে।
নগরী ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যুতের পোল থেকে শুরু করে সড়কের আইল্যান্ড ও রোড ডিভাইডার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরের দেয়াল, সরকারি স্থাপনা, বাসাবাড়ির দেয়ালসহ কোন কিছুই বাদ যায়নি পোস্টার-ব্যানারের ছোবল থেকে।
পাড়া মহল্লার অলিগলি তো বটেই, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম রাস্তা, ভিআইপি সড়ক, মার্কেট, রেলওয়ে স্টেশনের দেয়াল ও পিলার সহ অন্যান্য স্থাপনায় ঝুলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন সহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন। ঈদ শেষ হবার কয়েক মাস পরেও ঝুলছে ঈদের শুভেচ্ছা সম্বলিত পোস্টার-ব্যানার।
অতিরিক্ত হিসেবে যোগ হয়েছে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড কমিটি ঘটনের লক্ষ্যে কর্মীসম্মেলন কেন্দ্রিক বানানো পোস্টার-ব্যানার। কমিটি ও কর্মী সম্মেলন শেষ হয়ে যাবার পরেও মাসের পর পর মাস ঝুলছে ব্যানার-পোস্টার। ঐসকল পোস্টার ব্যানার আর প্রচারণার উপকরণের কারনে সৌন্দর্যমন্ডিত নগর সড়কে সৌন্দর্যহানির পাশাপাশি ঝুঁকি বাড়ছে যানচলাচলে। বিনষ্ট হচ্ছে সরকারি সম্পদ, রাসিক হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। সচেতন ব্যক্তি-পথচারি ও গাড়ি চালকরা বলছেন, রাস্তার আইল্যান্ড ও রোড-ডিভাইডারের চারিপার্শ্বে ঝুঁলানো পোস্টার আর ব্যানারের কারণে সড়কে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে; তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এবিষয়ে নজড়দারি ও পদক্ষেপ বাড়ানো দরকার বলে মন্তব্য নগরবাসির।
দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ অনুসারে, নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে না। যারা লাগাবেন সময়সীমার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগীকে তার দেওয়াল লিখন বা পোস্টার অপসারণ করতে হবে। সরকারিভাবে এসব অপসারণ করলে এতে কার্যক্রমের আনুষঙ্গিক ব্যয়ের সমুদয় অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগীর কাছ থেকে নগদ আদায় করবে। এই আইনের ব্যত্যয় ঘটলে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক মাসের কারাদন্ডের বিধানও রয়েছে।
গত ১৯ জানুয়ারি’২০২৫ তারিখে প্রায় ১৫ বছর পর রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী জেলা ও মহানগর জামায়াত ইসলামীর কর্মী সম্মেলন। কর্মী সম্মেলনকে ঘিরে দলটির পক্ষ থেকে প্রচার প্রচারণার উদ্দেশ্যে নগরীর বিভিন্নস্থানে ঝুলানো হয় ব্যানার পোস্টার। বিষয়টি শহরের সৌন্দর্যহানি ঘটার কারণে বিভিন্ন শিরোনামে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরেরদিন সম্মেলন শেষে দলটির নেতাকর্মীরা ব্যানার পোস্টারগুলো বিভিন্ন স্থাপনা ও ল্যাম্পপোস্ট থেকে অপসারণ করায় শহর পুণরায় ফিরে পায় নিজের সৌন্দর্য।
বছর দুয়েক আগে সমজাতীয় একটি প্রতিবেদন দৈনিক আমাদের রাজশাহী পত্রিকায় প্রকাশ হবার পর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অনুমোদনহীন পোস্টার ব্যানার অপসারণ করেছিলেন। কিন্তু এবার কেনো চুপটি করে বসে আছেন সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই কারো কাছেই। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মরতদের অনেকেই বলছেন, বিষয়টি হয়তো রাজনৈতিক কিংবা অন্যকোন কারণ হতে পারে।
এরও আগে আওয়ামী সরকারে আমলে চলতি দায়িত্বে থাকা মেয়র নিজাম-উল-আযীম নিযামের সময়ে দৈনিক আমাদের রাজশাহীর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে একবছরে রাসিকের লোকসান হয়েছিল প্রায় কোটি টাকার মতো। ঐসময় নগরীজুড়ে অনুমোদনবিহীন পোস্টার-ব্যানার আর ফেস্টুনে সয়লাব ছিল নগরীর প্রতিটিস্থান। বিশেষ করে কোচিং সেন্টার আর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রচার উপকরণ বছরজুড়েই ব্যবহার হয়েছিল নামমাত্র অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে। ‘রাসিক হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কয়েকদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেগুলো অপসারণ করেন।
রাজশাহী শহরের সৌন্দর্য রক্ষা এবং একটি স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে হলে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো সহ মাসের পর মাস সেগুলো ঝুঁলিয়ে রাখার প্রবোণতা বন্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য সচেতন নাগরিকদের। নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও পোস্টার, ব্যানার লাগালে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টির দিকেও নজড় দেয়া উচিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বলেও মন্তব্য তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র স্থপতি বলেন, ভালো কাজ করলে তা এমনিতেই ছড়িয়ে পড়ে। ব্যানার বা ফেস্টুন সাঁটানোর প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বের কোনো দেশেই এমনটি নেই। পাশের দেশেও নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রচার চালানো হয় মিডিয়ার মাধ্যমে। এতে নাগরিকের সমস্যা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। এতে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানেরও সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। আর সিটি করপোরেশন এসব অপসারণ করছে ঠিকই, তবে তা জনগণের টাকায়। এমনটা কাম্য নয়। যতই দিন যাচ্ছে নগরীর সৌন্দর্যহানি ঘটছে। ব্যানার-পোস্টার গ্রাস করছে নগরীর স্বাভাবিক সৌন্দর্য। প্রতিনিয়তই অমান্য হচ্ছে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ ২০১২।
নগরীর কোন কোন সড়কে লক্ষ্য করা গেছে, বাতাসে গাছের চিকন ডালের সঙ্গে দুলছে ব্যানার। কোন কোন সড়কে দেখামেলে বৈদ্যুতিক তার, টিএনটি ও ডিস-ইন্টারনেট লাইনের ক্যাবলের সাথেও ঝুলছে পোস্টার আর ফেস্টুনের কাঠ। কোন কোন সড়কের আইল্যান্ডের একপাশ দিয়ে বেড়িয়ে আছে পোস্টারের একাংশ ও ভঙ্গুর কাঠের অগ্রভাগ। কোন স্থানের পোস্টার আর ফেস্টুন ভেঙ্গে পড়ে আছে ছোট ও মাঝারি আকৃতির বাহারি রংয়ের ফুল গাছের উপর। পোস্টার ও বিভিন্ন ধরনের প্রচার উপকরণ ব্যবহারের কারণে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোর দৃষ্টিনন্দন আইল্যান্ড ও রোড ডিভাইডারের ভেতরে থাকা সৌন্দর্যবর্ধনকারি ফুল গাছগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতেও তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা।
রাস্তা সংলগ্ন ফুটপাত ও আইল্যান্ডের যত্রতত্র স্থানের মাঝারি ও বড় আকৃতির পোস্টার ও ব্যানারের কারণে চালকদের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। প্রচার উপকরণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি, ট্রাফিক বিভাগের স্থাপনাও। নগরীর কোন স্থানে ট্রাফিকদের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্মিত স্থাপনার চারিদিকে ব্যানার আর ফেস্টুন দিয়ে এমনভাবে ঘিরে দেয়া হয়েছে যে, কারোপক্ষেই ঐখানে প্রবেশ করা সম্ভব না। তাই অনূন্যপায় হয়ে রোদ-বৃষ্টিতে ভিজেই দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশকে। বিষয়গুলো বেশ বিব্রতকর বলে মন্তব্য অটোরিক্সা,ব্যাটারি চালত রিক্সা- বাইক ও প্রাইভেটকার চালকদের।
নাম ও পদ-পদবী প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি জানান, প্রচার উপকরণের ব্যবহার করে নগরীতে প্রচার কার্য চালাতে হলে নির্দিষ্ট হারে রাসিকের রাজস্ব শাখায় অর্থ প্রদানপূর্বক অনুমতি সাপেক্ষে সেটা করা যাবে। তবে, সেটিও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নিয়মানুযায়ী প্রচার সার্থে একটি পোস্টার শহরের কোন স্থানে ঝোঁলানো বা সাঁটানো হলে সেটির বিপরীতে রাসিককে সর্বনিম্ন সাত টাকা হারে (একদিনের জন্য) দেয়া লাগে। সেহিসেবে নগরীতে হাজার পোস্টার ব্যানার আর ফেস্টুন ঝুঁলছে। তাও আবার যত্রতত্রস্থানে লাগানো হয়েছে সেগুলো। ঝুঁলছে মাসের পর মাস। সেহিসেব নিকেষ করতে গেলে রাসিক হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। দায়িত্বশীল কর্তা-ব্যক্তিদের কাছ থেকে এমনটা কাম্য নয়।
এবিষয়ে রাসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সালেহ মোঃ নূর-ঈ-সাইদ দৈনিক আমাদের রাজশাহীকে বলেন, পরিচ্ছন্ন বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্ৰহণ করার জন্য বলা হয়েছে। বিষয়টি পরিচ্ছন্ন বিভাগের। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কেউ প্রচার প্রচারণা করলে সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নগরীতে প্রচার উপকরণ ব্যবহার করতে পারবেন।
জানতে চাইলে পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ডলার বলেন, নগরীর যত্রতত্র পোস্টার ব্যানার অপসারণের জন্য ঈদের আগে ও পরে একাধিকবার মাইকিং করা হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সেগুলো অপসারণের জন্য আমরা মাঠে নামবো।