চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ও বহু পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাঞ্চনা আনোয়ারুল উলুম ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা এবারের দাখিল পরীক্ষায় নিজেদের ইতিহাসে নজিরবিহীন ভরাডুবির মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ২০২৫ সালের দাখিল পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির পাসের হার মাত্র ৫০.৯১ শতাংশ।অর্ধেক পাস বাকি অর্ধেক পরিক্ষার্থী ফেল।জিপিএ ৫ নেই কেউ।মাদ্রাসার এমন বিপর্যয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাসহ সাধারণ মানুষ।লজ্জা কষ্টে কাঁদছেন কে এই পরিসংখ্যান শুধু হতাশাজনক নয়, বরং আশঙ্কাজনকও।
কারণ, প্রতিষ্ঠানটির অতীত রেকর্ড বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়— এমন দুরাবস্থা গত এক দশকে কখনও দেখা যায়নি।কেউ কেউ বলছেন মাদ্রাসার ইতিহাসে এমন বিপর্যয় কখনো ঘটেনি।ফলাফলের এমন ভরাডুবিতে প্রশ্ন উঠেছে মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা ও নানা বিষয় নিয়ে।
শিক্ষকদের ঠিকমতো ক্লাস না নেওয়া,শিক্ষকদের মাঝে সমন্বয়হীনতা,শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি অমনোযোগীতা, প্রশাসনিক দূর্বলতা ও অভিভাবকদের অসচেতনতাসহ বিপর্যয়ের নানা কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
মাদ্রাসাটিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (আয়া) দিয়ে রুটিন করে সপ্তম শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ ও সত্যতাও পাওয়া গেছে।
এ বছর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ৫৫ জন, এর মধ্যে মাত্র ২৮ জন পাস করেছে, আর ফেল করেছে ২৭ জন। একজনও জিপিএ-৫ অর্জন করতে পারেনি, যা প্রতিষ্ঠানটির গৌরবগাথা অতীতের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসাটি এক সময় সাতকানিয়া উপজেলার গর্ব ছিল। এখানকার শিক্ষার্থীরা শুধু জিপিএ-৫ নয়, বোর্ড মেধাতালিকায়ও স্থান করে নিত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তরিকতা, একাডেমিক শৃঙ্খলা এবং ধর্মীয় শিক্ষার পারদর্শিতার জন্য আলাদা পরিচিতি ছিল মাদ্রাসাটির।কিন্তু এবারের ফলাফল স্পষ্ট করে দেয়, সেই ঐতিহ্য আজ আর বেঁচে নেই। বরং, একটি সময়ের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আজ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে বিপর্যস্ত।
ফলাফলের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত বছর দাখিল ফলাফলে পাসের হারে শীর্ষে থাকলেও এবার সাতকানিয়ায় তলানিতে প্রতিষ্ঠানটি।এবার দাখিল ফলাফলে পাসের হারে উপজেলার ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩২ নাম্বারে নেমে এসেছে কাঞ্চনা মাদ্রাসা।যা নিয়ে ফলাফল প্রকাশের পর থেকে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
মাত্র পাঁচ বছরে যেখানে পাশের হার ৯৪% থেকে নেমে এসেছে ৫০%-এ, সেখানে প্রশ্ন উঠেছে — শিক্ষার মান কি শুধু অবনমিত হচ্ছে, নাকি প্রতিষ্ঠান কার্যত ভেঙে পড়ছে?
স্থানীয় একজন জানায়, যেখানে বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ অর্জন করত, আজ সেখানে অর্ধেক ফেল করছে। এর মানে, শিক্ষা কার্যক্রমে অভ্যন্তরীণ ত্রুটি ভয়ানক আকারে বাড়ছে।
মাদ্রাসার দাখিল-০৯ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, আমি অত্র মাদরাসা থেকে ২০০৯ সালে দাখিল এবং ২০১১ সালে আলিম পাশ করি।
দুটিতেই জিপিএ ৫ (এ+) অর্জন করি।এমন সফলতার পেছনে আমার বাবা মার পাশাপাশি আমার শিক্ষকদের অবদান ছিলো যথেষ্ট। ২০২৫ সালের কাঞ্চনা মাদরাসার দাখিল পরিক্ষার রেজাল্ট দেখে আমি অবাক হলাম।দীর্ঘদিন সফলতা ও সুনামের সাথে রেজাল্ট করা এ প্রতিষ্ঠানের এমন রেজাল্ট আমি সহ প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সবাইকে হতাশ করে।শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করলে শিক্ষকদের যেমন ক্রেডিট থাকে খারাপ করলে এটার দায়ও শিক্ষকদের অবশ্যই থাকে।প্রাক্তন পরিষদের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার এমন রেজাল্টের কারন খুঁজে বের করে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কমিটির নিকট দাবি রইলো।
মাদ্রাসার ২০১১ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আরমান হোসাইন বলেন, খারাপ ফলাফলের পিছনে অনেক কিছুই দায়ী।পড়ায় অমনোযোগী,শিক্ষকদের তদারকির অবহেলা,অপরিণত বয়সে মোবাইল ব্যবহার, পিতা মাতার অসচেতনতা।
২০১৬ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইকবাল হোসেন বলেন, এবারের মাদ্রাসার রেজাল্ট খুবই অসন্তোষ জনক, যা বিগতে সময়ে দেখা যায়নি। আমি মাদ্রাসার সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক তদারকির জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসার, অধ্যক্ষ মহোদয়সহ এলাকার শিক্ষানুরাগীরের বিশেষভাবে ভূমিকা রাখার আহবান জানাচ্ছি।
এদিকে কেউ কেউ সারাদেশের ফলাফলে যে বিপর্যয় সেটি কারণ হিসেবে দেখালেও মাদ্রাসাটির পার্শ্ববর্তী তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানের ভালো ফলাফল ভিন্ন কথা বলছে।
এদিকে এই বিষয়ে জানতে চাইলে কাঞ্চনা আনওয়ারুল উলুম সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান শামসী বলেন, মাদ্রাসা গতবছর এবং তার আগের বছর সাতকানিয়ায় প্রথম দ্বিতীয় হয়েছে।ছাত্ররা লেখাপড়ায় অমনোযোগী,কোচিং করতে বলার পরও কোচিং করেনি,ঠিকমতো ক্লাস করেনি।এমনকি দোয়া অনুষ্ঠানের জন্য তাদের ডাকলে তারা দোয়াও লাগবে না বলছে।