ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের আকাশপথ ব্যবস্থাপনা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও বেশ কয়েকটি বড় ও ছোট উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর দাগ ফেলেছে। এসব দুর্ঘটনার শিকার কখনও বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ, কখনওবা প্রশিক্ষণ বিমান। বিশেষত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীসহ বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় মেধাবী প্রশিক্ষণার্থীর অকাল মৃত্যু অনেককে কাঁদিয়েছে।
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় বিমান বাহিনীর বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও দুর্ঘটনায় ২৫ জনকে উদ্ধার করে ইতোমধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে নেয়া হয়েছে।
এর আগে দুপুর ১টা ১৮ মিনিটের দিকে উত্তরার দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজেআই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির। কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সবুজ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, স্কুলের দোতলা ভবনের প্রবেশ মুখে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। কিছু শিক্ষার্থী বের হয়ে গেলেও অনেকে ভেতরেই ছিল। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরই আগুন ধরে যায়।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উত্তরায় বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করেছিল। এর ১২ মিনিটের মাথায় ১টা ১৮ মিনিটে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ ও যাত্রীবাহী মোট ১৫টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্টের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে হৃদবিদারক ও মর্মান্তিক। সেদিন বিমানের এফ-২৭ ফ্লাইটটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় আসার পথে বিধ্বস্ত হলে দেশের প্রথম নারী পাইলট কানিজ ফাতিমা, বিমানের কো-পাইলটসহ মোট ৪৯ জন প্রাণ হারান। এর আগে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম বিমান দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ম্যাগডোনালস ডগলাস কোম্পানির তৈরি ডিসি-৩ এয়ারক্রাফটটি বিধ্বস্ত হলে পাঁচজন ক্রু নিহত হন।
১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক দুঘটনায় বিমানবাহিনীর তখনকার প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খাদেমুল বাশার ও স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হক নিহত হন। এই সাহসী বৈমানিক, বিমানবাহিনীর প্রধান সেদিনই ঢাকায় বিমানবাহিনীর উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ স্কুলের উদ্বোধন করেন ।জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে উদ্বোধন শেষে তিনি উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ স্কুলের অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে উদ্বোধনী ফ্লাইটের একটি বিমানে চড়ে আকাশে উড়লেন। উপস্থিত সবার চোখ তখন আকাশে।
হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। সবাই হতবাক হয়ে দেখছে তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশেই একটি ভবনের উপর এসে বিমানটি সজোরে পতিত হয়। উড্ডয়নের পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ভয়ংকর এক শব্দে স্তব্ধ হয়ে যায় উপস্থিত সবার হৃদয়। একই সঙ্গে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় জাতির একজন শ্রেষ্ঠসন্তান অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার ও স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হকের জীবন।
১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের সময় এয়ার পারাবতের একটি বিমানে আগুন ধরলে ঢাকার পোস্তগোলায় বিধ্বস্ত হয় এবং পাইলট ফারিয়া লারা ও কো-পাইলট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম নিহত হন।
২০০৮ সালে জেসি-৫ কে-৮ কারাকোরাম মডেলের একটি প্রশিক্ষণ বিমান কুমিল্লায় বিধ্বস্ত হয়। তবে পাইলট এবং প্রশিক্ষণার্থী দু’জনই বের হতে সমর্থ পারেন। পরে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
২০১৪ সালে টাঙ্গাইলে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে দু’জন পাইলট অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমির আকাশে বিমান বাহিনীর একটি ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তবে দুজন পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে আসেন।
২০২২ সালের মে মাসে সিলেটের ওসমানী নগরে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এটি ছিল একটি পিটি-৬ মডেলের বিমান। দু’জন পাইলটই প্যারাস্যুট ব্যবহার করে নামতে সক্ষম হন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের ইনানীতে একটি এফ-৭ বিএজি মডেলের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয় এবং পাইলট নিহত হন।সর্বশেষ উত্তরার আজকের দুর্ঘটনায় আবারো নতুন করে এই দীর্ঘ তালিকায় একটি নাম যুক্ত হলো।
এদিকে যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কিছু দুর্ঘটনার মধ্যে রয়েছে ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রামের কাছে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার এফ-২৮ রানওয়ে থেকে ছিটকে যায়, কয়েকজন যাত্রী আহত হন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ বিমানের ফকার বিমান সৈয়দপুরে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়। এত কয়েকজন হতাহত হন। ২০১২ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জরুরি অবতরণের পর বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। ২০১৯ সালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলট-কোপাইলটসহ ৫১ জন প্রাণ হারান। এটি দেশের সীমানার বাইরে ঘটলেও এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা।
বিমান দুর্ঘটনা একটি জাতির জন্য শুধু মেধাবীকে হারানোর বেদনা নয়, বরং এটি পর্যালোচনার করে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ এনে দেয়। প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটলেও এটি কাঠামোগত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। সেই দুর্বলতা চিহ্নিত করে সমাধানে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গৌরব আরও দৃঢ় হবে, এবং আমাদের আকাশপথ আরও নিরাপদ হয়ে উঠবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh