রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে, ডিনস কমপ্লেক্সের শান্ত ছায়ায় বইয়ের পসরা নিয়ে বসেন এক তরুণ, যাঁর আন্তরিক মুখ সহজেই নজর কাড়ে। পুরনো আর নতুন বইয়ের স্তূপের মাঝে তিনি যেন এক আপন ভুবন তৈরি করেছেন।
এই উদ্যমী তরুণের নাম মো. মাহবুব আলম, যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। জীবনের এক কঠিন বাঁকে, ২০০৮ সালের একটি দুর্ঘটনায় তিনি একটি চোখ হারান।
তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর মনের আলো নিভিয়ে দিতে পারেনি। বরং একটি চোখে দৃষ্টি কম থাকা সত্ত্বেও, বইয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তাঁকে এক নতুন জগৎ দেখিয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চত্বর মুখরিত থাকে তাঁর বই বিক্রি এবং সাহিত্য আড্ডায়।
তিনি রাজশাহীর মেহেরচন্ডী বুধপাড়ার বাসিন্দা। পরিবারে আছে ১ ভাই ১ বোন ও বাবা-মা। তিনি সবার ছোট।
২০২২ সালের মার্চ মাসের ২২ তারিখ থেকে মাহবুব এই বই ব্যবসার শুরু করেন। ক্লাসের ফাঁকে অথবা ছুটির দিনগুলোতে ডিনস কমপ্লেক্সের পেছনে তার অস্থায়ী দোকানে ভিড় করে বইপ্রেমীরা। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি তার গভীর টান। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে জেলা লাইব্রেরি পর্যন্ত ছিল তার অবাধ আনাগোনা। সেই ভালোবাসাই আজ তাকে বই ব্যবসার পথে টেনে এনেছে। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত বসেন তিনি।
মাহবুব জানান, পুরনো বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো বই সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন তিনি। অপ্রত্যাশিত সাড়া পেয়ে উৎসাহের সাথে এই কাজ চালিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বই বিক্রিকে উপার্জনের একটি উৎস হিসেবে দেখেন মাহবুব। বিভিন্ন জায়গা থেকে বই সংগ্রহ করে কম দামে বিক্রি করার ভাবনা তার কাছে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক, তেমনি তার নিজের চলার পথের পাথেয়।
শুধু বই বিক্রিই নয়, মাহবুবের রয়েছে একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থাও – ‘বর্ণশুদ্ধ প্রকাশনা’। এই প্রকাশনা থেকে তার প্রথম দুটি বই, একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ ও একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রকাশনা নিয়েই কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এবারের বইমেলায় তার লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে – ‘ফিলিস্তিনে শিশু বন্দী ও নির্যাতন’।
তবে এই স্বপ্নযাত্রায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। মাহবুব অকপটে বলেন, “বইগুলো সংগ্রহ করতেও তো অর্থের প্রয়োজন। অনেক ছোট ও বড় ভাইরা বিভিন্ন বইয়ের খোঁজ করেন। আমার কাছে যদি পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা থাকত, তাহলে আমি সেই বইগুলো স্টক করে রাখতে পারতাম এবং সকলের চাহিদা পূরণ করতে পারতাম।”
বন্ধুরা তার এই উদ্যোগকে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছে। এক বন্ধু এক বছর তার সাথে এই কাজেও সহযোগিতা করেছে। পরবর্তীতে চাকরির সন্ধানে সেই বন্ধু সরে গেলেও, অন্যদের সমর্থন আজও অটুট। বরং, মাহবুবের এই কর্মোদ্যোগ তাদের মাঝেও এক ধরনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অনেকেই তার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তে ও জ্ঞানার্জন করতে আগ্রহী।
পরিবারও মাহবুবের এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানায়। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন করতে পারায় তারা খুশি। মাহবুব কখনোই অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন না। তার এই স্বনির্ভরতা তাদের কাছে বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। প্রতিদিন ১ থেকে ২ হাজার টাকার মতো বিক্রি করেন বই। এই টাকায় দৈনন্দিন খরচ ঠিকমতো চলে যায় তার।
এক চোখে স্বপ্ন আর বুকে সাহিত্যের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে চলা মাহবুব আলম আজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। বইয়ের জগতে তার এই নিরলস পথচলা শুধু তার ব্যক্তিগত সংগ্রাম নয়, বরং জ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি এক অদম্য ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পুরনো বইয়ের পাতায় নতুন দিনের স্বপ্ন বোনা এই তরুণ উদ্যোক্তা নিশ্চিতভাবেই একদিন তার ‘বর্ণ প্রকাশনা’কে আরও বিস্তৃত দিগন্তে নিয়ে যাবেন।