চট্টগ্রামের উপকূলে বঙ্গোপসাগরের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠছে এক ব্যতিক্রমধর্মী ম্যানগ্রোভ বন, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত হচ্ছে ‘নয়া সুন্দরবন’ নামে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সুন্দরবনের অনুরূপ প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের এই প্রয়াস দেশের উপকূলীয় বনায়নে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের অধীনে কাট্টলী বিট এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে গড়ে তোলা এ বনাঞ্চলে ইতোমধ্যে রোপণ করা হয়েছে গেওয়া, কেওড়া, ছৈলা, হারগাজা, খলশী, বাইন, পশুর, কাকড়া ও সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রতীক বৃক্ষ ‘সুন্দরী’ গাছ।
জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত চরের মাটি এই বন গঠনের জন্য উপযোগী। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা, চারা উৎপাদন ও ভূমি প্রস্তুতির মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রকৃতি ও শহরের মাঝে সেতুবন্ধন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. মোল্যা রেজাউল করিম বলেন,“নয়া সুন্দরবন শুধু বন নয়, এটি নগর জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির একটি গভীর সংযোগ। এটি একদিকে পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে শিক্ষামূলক পর্যটন, মৌচাষ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলবায়ু সহনশী নগর পরিকল্পনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করবে।”
নাগরিক অংশগ্রহণে স্বপ্নের বাস্তবায়ন- এ প্রকল্পের পেছনে রয়েছেন একদল স্বপ্নবান মানুষ। তাঁদের অন্যতম চট্টগ্রামের পরিবেশকর্মী ও আলওয়ান মধু যাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মঈনুল আনোয়ার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় মৌমাছি সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রস্তাবনা ও সক্রিয় অংশগ্রহণে বনটিতে যুক্ত হয়েছে মৌমাছিবান্ধব বৃক্ষ ও প্রাকৃতিক উপাদান। মৌসঙ্গঠনে তার অবদান ইতোমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় টেকসই উদ্যোগ- প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন উপ-বন সংরক্ষক এম. এ. হাসান, রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামান এবং স্থানীয় বনকর্মীরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশ সচেতন জনগণও এই প্রকল্পে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
এক নতুন সম্ভাবনার নাম ‘নয়া সুন্দরবন’ বিশ্বজুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তখন এই প্রকল্প শুধু পরিবেশ রক্ষার প্রয়াস নয়, বরং আশাবাদের এক প্রতীক হিসেবে সামনে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরঘেঁষা এই ম্যানগ্রোভ বনায়ন সারা দেশে পুনরুত্পাদনযোগ্য মডেল হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।
‘নয়া সুন্দরবন’ কেবল একটি বন নয় এটি একটি সবুজ স্বপ্ন, পরিবেশ সচেতনতায় নাগরিক জাগরণ ও টেকসই ভবিষ্যতের পথরেখা। প্রকৃতির সুরে মানুষ আবার সুর মিলিয়ে বাঁচতে পারে—এই বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এক অনন্য উদাহরণ।