× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

জুলাই অভ্যুত্থানের একবছর

ফিরে দেখা ৪ আগস্ট, সেদিন মৌলভীবাজারের চৌমুহনা চত্বর হয়ে উঠে আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট

মো: আব্দুল কাইয়ুম,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি।

০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫০ পিএম

ছবিঃ সংগৃহীত।

ঘটনাবহুল ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। সেদিন বারটা ছিল রবিবার। বছর ঘুরে ফের হাজির দুঃশাসন আর নারকীয় সব ঘটনার স্বাক্ষী সেই ৪ আগস্ট। এ দিন রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহর সহ দেশের ৬৪টি জেলা জুড়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ফ্যাসিবাদ পতনের একদফা দাবিতে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে পর্যটন অধ্যুসিত মৌলভীবাজার জেলায়ও। এর আগে জুলাই জুড়ে ঢাকার সাথে কর্মসূচি সমন্বয় করে মৌলভীবাজারের রাজপথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু হয়।

১৭ জুলাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে শহরের শাকুরা মার্কেটের সামনে ছাত্রলীগ পুলিশের সামনেই শিক্ষার্থীদের উপর লাটিসোঠা ও হকিস্টিক দিয়ে বেপরোয়া হামলা চালায়। আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। ওই দিনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আহত হন আব্দুস সালাম নামে এক আন্দোলনকারী। এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতেও আন্দোলন অব্যাহত রাখেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।

সেসময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড় আর আওয়ামীলীগের ক্ষমতাধর নেতাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধিরে ধিরে প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিও বাড়তে থাকে শহরের রাজপথে। আন্দোলনের পরিধি যতো বাড়তে থাকে ততই আওয়ামীলীগ,ছাত্রলীগ,যুবলীগ সহ তাদের সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্দয় ও আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।

৪ আগস্ট মৌলভীবাজারের রাজপথে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ সহযোগী সংঘঠনের নেতাকর্মীদের সংঘঠিত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র সহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র মহড়া আর নৃশংস হামলার কারণে চিরায়ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পতন ঘটে শান্ত এ শহরে। এতে বিক্ষোব্ধ ও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে জনতা। আন্দোলনের ঢেউ শুধু মৌলভীবাজার শহরেই নয়, একই সাথে জেলার ৭টি উপজেলাও ছড়িয়ে পড়ে জনতার বিস্ফোরণ।

আর মৌলভীবাজারের চৌমুহনা হয়ে উঠে আরেক তাহরীর স্কয়ার। শহরমুখী জনতার  স্রোত এসে মিলিত হয় চৌমুহনা চত্বরে। সেদিন এই স্থানটি হয়ে উঠে আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। এদিন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে কর্মসূচি হলেও ফ্যসিবাদ বিরোধী সব মত-পথের নিপিড়ীত জনতা মাথায় লাল সবুজের পতাকা আর নানা প্রতিবাদী শ্লোগান সস্বলিত প্লে­কার্ড সাথে নিয়ে শহরের অলিগলিতে আন্দোলনে যোগ দিতে বেড়িয়ে পড়েন জীবনের মায়া ছেড়ে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১২টায় শহরের সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা।

মিছিলটি চৌমুহনী পয়েন্টে আশা মাত্রই তৎকালীন  মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে হামলা চালায়। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।


এসময় শিক্ষার্থীরা জেলা আওয়ামীলীগ কার্যালয়ের সাইনবোর্ড সহ বিভিন্ন সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে এবং সাইফুর রহমান সড়ক, শমসেরনগর সড়ক ও চাঁদনীঘাট সড়কে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এদিন শহরের চৌমুহনা,সমশেরনগর সড়ক, সাইফুর রহমান সড়কে আন্দোলনকারীদের উপর সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

পাশাপাশি ৮ জন সাংবাদিকও আহত হন। ভাঙচুর করা হয় ক্যামেরা ও সাইকেল। শুরু থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখলেও বেলা ৩টার দিকে এ্যাকশনে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড মেরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশ শহরের সেন্ট্রাল রোড, কোর্ট রোড, শমসেরনগর রোড ও চাঁদনীঘাট রোডে ফাঁকা গুলি ছুড়ে। মুহুর্তেই বন্ধ হয়ে যায় মার্কেট,শপিং মল, বিপণী বিতান সহ শহরের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আর চরম আতঙ্ক। সন্ধ্যার পর পুরো শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। উদ্বেগ আর চরম আতঙ্ক নিয়ে শহরের রাজপথ ফাঁকা হয়ে যায়। তবে চিহ্ন রেখে যায় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ক্ষতচিহ্ন। ৪ আগস্ট ছিল শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মৌলভীবাজার জেলা শহরে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আন্দোলন।


আন্দোলনে যুক্ত মাওলানা এহসান জাকারিয়া ৪ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেদিন আরিফ নামে একজন আন্দোলনকারীর উপর আওয়ামীলীগের নৃশংস হামলার ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে নিন্দার ঝর উঠে। তিনি বলেন, এর আগে মৌলভীবাজারে যে যার মতো করে কর্মসূচি পালন করলেও হামলার ঘটনা ঘটেনি। মৌলভীবাজারে সবসময় রাজনৈতিকভাবে ভাল অবস্থান বিরাজ করছিল। কিন্তু ৪ আগস্ট সেই পরিবেশ রাখেনি আওয়ামীলীগ।

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ আহমদ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, হামলার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। তিনি বলেন, সেদিন চাদনীঘাট সড়কের জেলা জজ এর বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় আওয়ামীলীগ। তখন হামলার মুখে শিক্ষার্থীরা পিছু হটে। কিন্তু আমি ওই স্থান থেকে পিছু হটার সুযোগ পাইনি। তারা তিনদিক থেকে আমার উপর হকিস্টিক আর লাটিসোঠা নিয়ে হামলে পড়ে। জানতে চ্য়া কেন আন্দোলনে এসেছি। আমি জানাই আমিতো কারো উপর হামলা চালানোর জন্য আসিনি। তবুও তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি। একপর্যায়ে ব্যাপক হামলার মুখে আমি পড়ে যাই। আমার শরীরের হাত-পা কিছুই কাজ করছিলনা। পানি চেয়েছিলাম তারা পানি দেয়নি। পড়ে দুইজন ওয়াইফাই কর্মী আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেয়ার পথেও পুলিশ আমার কলার চেপে রাস্তায় দাড় করিয়ে রাখে। এসময় পিছন থেকে একজন আমার মাথায় আঘাত করে।

আন্দোলনে অংশ নেয়া মৌলভীবাজার বারের তরুণ আইনজীবী ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট নিয়ামুল হক বলেন, ৪ আগস্টকে কেন্দ্র করে একসাপ্তাহ আগেই নেয়া হয় পরিকল্পনা। যার কারণে ৩ আগস্ট রাতেই শহরের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে অবস্থান নেন প্রায় দেড়হাজার শিক্ষার্থী। যার পিছন থেকে সাহস আর ব্যাপক ভুমিকা রাখে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন। ৪ আগস্ট এর দুদিন আগে ছাত্রদের গ্রেফতারে তাদের অনুরোধে আইনি সহাতায় এগিয়ে আসি। এর পর ফেসবুক পোস্টে তাদের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা দিয়ে মাঠে থাকি। তিনি বলেন,৪ আগস্ট বিকাল ৫টা পর্যন্ত মাঠে সক্রিয় ছিলাম। এর পর আমার কাছে বার্তা আসে মাঠ থেকে সরে যেতে,আমার উপর না কী গুলির ওযার্ডার রয়েছে। এর পর প্রশাসন ও আওয়ামীলীগ আমার উপর চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তবুও দমে যাইনি। হাল ছাড়িনি।

ওদিকে ৪ আগস্ট পেড়িয়ে পরদিন ৫ আগস্ট  দুপুর গড়াতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা পতনের। সেই সাথে হাসিনার গণভবন ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাবার। এমন খবরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মৌলভীবাজারের মুক্তিকামী জনতা। মুহুর্তেই পাল্টে যায় শহরের চিরচেনা দৃশ্যপট। বৃষ্টিময় ওই দিনে পুরো শহরে লোকজন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। শহর হয়ে উঠে লোকে লোকারণ্য। পরিণত হয় মিছিলের শহরে। চারিদিকে স্বস্তির পাশাপাশি বিরাজ করে ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ। সময়ের ব্যবধানে শহরের রাজপথ থেকে উধাও হয়ে যায় আওয়ামীলীগের সব দাপুটে ক্ষমতাধর নেতারা। যে যার মতো করে সহায়-সম্বল রেখে পালাতে শুরু করে। শুরু হয় নতুন শহেরর অচেনা পথচলা। ইতিহাসের পাতায় রেখে যায় জুলাই আন্দোলনরে পাশবিক ও নারকীয় চিহ্ন। পতন হয় আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সাড়ে ১৫ বছরের কালো অধ্যায়ের। উদিত হয় নতুন সূর্যদয়ের।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.