রোববার (১০ আগস্ট) বিকেলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। আগামী নির্বাচনে আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমাদেরকে দেশকে গড়তে হবে। স্বৈরাচার শিক্ষা, বিচার, আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। আগামী নির্বাচনে আমরা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলে আমাদের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।’
দেশ গড়তে বিএনপিই প্রথম সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আড়াই বছর আগে স্বৈরাচার সরকারের আমলেই আমরা বাংলাদেশের মানুষের সামনে ৩১ দফা উপস্থাপন করেছিলাম। সেই ৩১ দফার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি দিয়েছিলাম। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এখন সংস্কারের জন্য যেসব আলোচনায় আসছে, অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি আড়াই বছর আগেই জাতির সামনে ঘোষণা করেছিল। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি এই দেশকে যদি এগিয়ে নিতে হয় তাহলে কতগুলো ব্যাপারে রাষ্ট্রের সংস্কার করতে হবে। সেই জন্য অন্য কেউ চিন্তা করার আগে আমরা বিএনপি আড়াই বছর আগে সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘বিগত স্বৈরাচারের সময় এমনভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সাজিয়েছিল, যাতে পার্শ্ববর্তী একটি দেশে গিয়ে মানুষ সেবা নিতে বাধ্য হয়। এই দেশে হাসপাতাল ধ্বংস করে ইচ্ছে করে রোগীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে দিত। তারা চিকিৎসার নামে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দিত। আমাদের এখন নিজস্ব চিকিৎসক ও নার্স গড়ে তুলতে হবে, যাতে দেশের মানুষ এই দেশের হাসপাতালেই উন্নত চিকিৎসাসেবা পায়।’
তারেক রহমান বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকার জনগণের আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারা এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতা দখল করে ছিল। কীভাবে তারা গুম, খুন, হত্যা শুরু করেছিল আমরা দেখেছি। তারা বিরোধী মতের মানুষের বিরুদ্ধে কীভাবে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল দেখেছি। এই সম্মেলনে যারা উপস্থিত তাদের অধিকাংশ মানুষ মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছেন। শুধু বিএনপি নয়, বিএনপির বাইরেও বহু রাজনৈতিক দল আমাদের সঙ্গে ছিল, ছোটবড় যেমন দল হোক না কেন, যারা মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সোচ্চার ছিল, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। গুম-খুন করেছে। আমরা রাজনীতি করেছি, কিন্তু পরিবারের যে সদস্য রাজনীতি করেনি- তাকেও হয়রানি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু রাজনৈতিক দল নয়, রাজনীতির বাইরেও বহু সাধারণ মানুষ যারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা দেখেছি কীভাবে অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালানো হয়েছে। আমরা দেখেছি, সেই সময় কীভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেটি যে কোন নির্বাচনই হোক, প্রতিটি পর্যায়ে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে দেয়া হয়েছিল। বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনীতিকরণ করে ধ্বংস করা হয়েছে। অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়েছে। মেগা উন্নয়নের নামে মেগা দুর্নীতি করা হয়েছিল। কীভাবে অর্থ সম্পদ লুট করে পাচার করা হয়েছে তা আমরা দেখেছি।’
তারেক রহমান বলেন, ‘আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা। আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। এখন আমাদের জনগণের শাসন, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর মূল উপায় হলো, জনগণের সরাসরি ভোট প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। সেই ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ নির্ধারণ করবে, কে আগামী দিনে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করবে।’
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার সেই পথে এগোচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার সরকার সেই পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা কবরা হয়েছে- আগামী রমজানের আগে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের অধিকারের প্রথম পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হবে। এখন ভোট হলেই হবে না, ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করলেই হবে না। জনগণ বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে জানতে চায়, দেশের ভবিষ্যৎ কী। বিএনপি আগামীতে কি করবে? কেন মানুষ জানতে চায়? কারণ, বাংলাদেশের জনগণ, বিএনপির ওপরে আস্থা রাখতে চায়।’
তারেক রহমান বলেন, ‘যুবক-বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশে এবং বিদেশে তাদের কর্মসংস্থান করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সবস্তরে ভাল শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। এই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ।’
‘বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আজ ফারাক্কার কারণে পদ্মা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। সুজলা-সুফলা এলাকা পদ্মা নদীর পানির অভাবে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। পানির নায্য হিস্যা পেতে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব। জাতিসংঘে যাব প্রয়োজন হলে। আমাদের পানির ব্যবস্থা করতে হবে। খালগুলো সংস্কার করতে হবে যেন তারা পানি নিয়ে আবার ঝামেলা করলেও যেন এখানে পানি থাকে।’
তিনি বলেন, ‘সামনে অনেক কাজ। অনেক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হবে। ছোট ছোট কলকারখানা গড়ে তুলতে হবে। উৎপাদিত দ্রব্য দেশে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার কাছে বহু মানুষকে যেতে হয়। কিন্তু আমরা দেখছি বিচার ব্যবস্থার জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বছরের পর বছর মানুষকে কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয়। আমাদের এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে, যাতে মানুষ দ্রুত বিচার পায়। কৃষির চ্যালেঞ্জ আছে। সঠিক সময়ে সার পৌঁছাতে হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। মানুষ যাতে স্বল্পমূল্যেপণ্য পায় সেটা দেখতে হবে, একইসাথে কৃষকরা যেন সঠিক মূল্য পায়।’
বিএনপির পক্ষেই সম্ভব এবং তা দেশের মানুষ বিশ্বাস করেন জানিয়ে দলের এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘মানুষ এখন বিশ্বাস করে একমাত্র বিএনপির পক্ষেই সম্ভব ধীরে ধীরে এই দেশকে গড়ে তোলা। আজ দেশের অধিকাংশ মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জগুলো যদি মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে আমাদের প্রথমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, তাহলে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারব না। জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য দুই হাত তুলে প্রতিজ্ঞা করিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা দেশের মানুষের সামনে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। পরবর্তী পদক্ষেপ আমাদের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করা। বেকারদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, নদীখনন, খালখনন- এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। তার জন্য দরকার ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আমাদের ডিসিপ্লিন হওয়া দরকার। রাজশাহী মহানগরে আমার প্রত্যাশা থাকবে, আমরা সবাই শপথ গ্রহণ করব যে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকব এবং দেশকে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেব।’
এর আগে সকাল থেকে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান সংলগ্ন মাঠে মহানগর বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠান শুরু হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা আব্দুস সালাম। বক্তব্য দেন- আরেক উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, দলের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সহসম্পাদক শফিকুল হক মিলন, রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন শওকত প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা। সম্মেলন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সদস্যসচিব মামুন-অর-রশিদ মামুন।