× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

শ্রম আর চাঁদায় উঠে গেল পিলার, নিজেরা সেতু গড়ছে মানিকগঞ্জের এক গ্রাম

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি ।

১৩ আগস্ট ২০২৫, ১৪:২৭ পিএম

ছবিঃ সংগৃহীত।

দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে এক অনন্য উদ্যোগ নিয়েছেন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার কান্দাপাড়া গ্রামের মানুষ।সরকারি দপ্তরে বার বার ধরনা দিয়েও মেলেনি সমাধান। সরকারি সহায়তা না পেয়ে হতাশ না হয়ে, তারা নিজেরাই হাতে তুলে নিয়েছেন ব্রিজ নির্মাণের কাজ। এতে নদীর এই অংশে মানিকগঞ্জ  ও ঢাকা জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ হবে।

গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গাজিখালী নদী বহুদিন ধরেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত। স্কুল, কলেজ, বাজার কিংবা হাসপাতাল—সব জায়গায় পৌঁছানো ছিল সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। কান্দাপাড়াবাসী আর অপেক্ষা করেননি। নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে, শ্রম দিয়ে শুরু করেছেন সেতু নির্মাণের কাজ। বর্তমানে নদীর দুই পাশে সেতুর পিলার দাঁড়িয়ে গেছে—যা দৃঢ় সংকল্পের পরিচায়ক। 

এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন: “সরকারি সাহায্য না পেয়ে আমরা হতাশ হলেও বসে থাকিনি। সবাই মিলে চাঁদা তুলে এই ব্রিজের কাজ শুরু করেছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে কষ্ট না পায়, সেই চিন্তা থেকেই এই উদ্যোগ।” গ্রামের তরুণদের পাশাপাশি বৃদ্ধরাও শ্রম দিয়েছেন নির্মাণকাজে। স্থানীয় রাজমিস্ত্রী, ইঞ্জিনিয়ার ও সাধারণ মানুষ এক হয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন কাজটি।

এলাকাবাসীর মতে, এই ব্রিজ কেবল যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, এটি এই এলাকার অর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা শিক্ষা প্রসার ও দুই পাড়ের মানুষের মাঝে আত্মিক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে।

মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের 'কান্দাপাড়া ’ নামক স্থানে গাজিখালি নদী ওপর এই সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।সেতুটির ৮০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৮ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান এলাকাবাসী। 

বুধবার (১৩ আগস্ট ) সরেজমিনে দেখা যায়, এই সেতু নির্মাণ করা হলে গাঙ্গুটিয়া, ধানকোড়া,কৃষ্ণপুর ও আটিগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় সাত গ্রামের মানুষের যাতায়াত সহজ হবে। এই রাস্তা দিয়ে ওই এলাকার বাসিন্দারা বারোবাড়িয়া  বাজারসহ কয়েকটি হাট-বাজারে যাতায়াত করেন। সেতু না থাকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও গ্রামের বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কমপক্ষে এক থেকে দেড় কিলোমিটার ঘুরে অন্য রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়।

সাবেক মন্টু মেম্বারের ছেলে নাহিদ বলেন, কৃষ্ণপুর-কান্দাপাড়ার গাজীখালি নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি ছিল প্রায় ছয় গ্রামের বাসিন্দাদের। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের এ দাবির প্রতি নজর দেননি কোনো জনপ্রতিনিধি।  এ অবস্থায় সম্মিলিতভাবে নিজ উদ্যোগে সেতু নির্মাণে কাজ শুরু করেছে গ্রামবাসী। 

স্থানীয় বাসিন্দা সুমন বলেন, গাজীখালী নদীতে একটি সেতুর অভাবে নদীর দুই পাড়ের গ্রামগুলোর লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে ছিলেন। তাদের চলাচলে কষ্টের শেষ ছিলো না। বিশেষ করে বর্ষাকালে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচলে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো। তাদের একমাত্র ভরসা ছিলো সাকো ও খেয়া নৌকা। একটি সেতুর জন্য এলাকাবাসী সব সময়ই আকুতি জানিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা জনপ্রতিনিধিদের কাছে সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধিরা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা দীর্ঘ সময়েও বাস্তবায়ন হয়নি। এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারমানের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন একটি সেতু নির্মাণের জন্য। তারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এলাকাবাসীর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে।

গ্রামবাসী কেন নিজের কাঁধে তুলে নিলো, এই সেতু নির্মাণ কাজ ?  এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দা মকসেদ বলেন, 'এখানে নদী পারাপারের কোন সেতু নেই। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়া গেলেও বর্ষাকালে পানিতে ছোট ছোট নৌকাই ভরসা। যার ফলে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নারী-শিশু ও শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষকে। দিনের পর দিন শুধু আশ্বাসই পেয়েছি আমরা। আশ্বাসে আর বিশ্বাস নেই। তাই নিজেদের চলার পথটি সহজ করতে, কারো আশায় বসে না থেকে নিজেরাই সেতু নির্মাণে অংশ নিয়েছে গ্রামবাসী'।

মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী রাসেল জানায়, সেতু না থাকায় তারা ঝুঁকি নিয়ে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে কলেজে যেত। ব্রিজ নির্মাণ হলে সকলেই নির্বিঘ্নে পারাপার হতে পারবে।  সাঁকো দিয়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। কেউ অসুস্থ হলে রোগী কে মাইক্রোবাস, অটোবাইক কিংবা মোটরসাইকেলে সাটুরিয়া উপজেলা ও মানিকগঞ্জ শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় যেতে তাদের দুই কিলোমিটার পথ ঘুরে যেতে হয়। এই ভোগান্তি এখন দূর হবে।

সেতু নির্মাণ তহবিলের ক্যাশিয়ার শরিফুল ইসলাম বলেন, “রোজার ঈদের আগে আলোচনা করে নিজেদের টাকায় ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেই। গ্রামের বিত্তশালীসহ সর্বস্তরের লোকদের কাছে সেতু নির্মাণের জন্য আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়।ইতোমধ্যে প্রায় ২০ লাখ টাকা সংগ্রহ হয়েছে। বালু, রড, সিমেন্ট, খোয়া দিয়ে নদীর ওপর ব্রিজের জন্য মোট দুই জোড়া খাম্বা (পিলার) নির্মাণ করা হয়েছে ও ব্রিজের অন্য কাজগুলো ও তার সাথে চলছে। 

শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, সেতু নির্মাণের জন্য যে টাকা তোলা হয়েছে তা দিয়ে এ পযন্ত কাজ করেছি। পরবর্তীতে পাটাতন ঢালাই দেওয়ার জন্য আরও টাকার প্রয়োজন হবে। তবে আমাদের তহবিলে টাকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছা করলে কেউ আমাদের এ কাজে সহযোগিতা করতে পারেন।সবার সাহায্য সহযোগিতা পেলে কাজটি দ্রুত শেষ করতে পারবো।

সাটুরিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস খান মজলিস বলেন, “কান্দাপাড়ার মানুষ সত্যিই একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গাজিখালী নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ তারা নিজেরা নিয়েছেন—এটি আমাদের উপজেলার মানুষের ঐক্য, সাহস এবং স্বনির্ভরতার প্রতীক। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই।”

মানিকগঞ্জ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আশরাফুল ইসলাম রাজু বলেন, “যে এলাকায় জনগণকে নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে ব্রিজ নির্মাণ করতে হয়, আর সরকারি দপ্তরে আবেদন করেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না— সেই এলাকার মানুষের উচিত নির্বাচনের সময় সচেতন অবস্থান নেওয়া উচিত।”

উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৪০/৫০ বছরের বেশি সময় ধরে লোকজন জোড়াতালি দিয়ে বাঁশের সেতুটি ব্যবহার করে আসছে। বছরের পর বছর সেটা মেরামত করে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে তারা। বছরের শুরুতে প্রথমদিকে এটি পারাপারর অযোগ্য হয়ে পড়ে। সেই সাথে গত, ১৭ বছর ধরে তারা গাজীখালি নদীর ওই জায়গায় একটি সেতু নির্মাণের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমনকি স্থানীয় এমপির কাছে তারা এ সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়াও কয়েকবার আবেদন করেছেন উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এ কাজে সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা না পেয়ে গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই টাকা তুলে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। 

এলাকাবাসীর দাবি ব্রিজটি সম্পন্ন হলে উদ্বোধন করবেন এলাকার সাধারণ মানুষ, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়, যাতে এটি জনগণের ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকে।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.