× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

লাইফ জ্যাকেটহীন উত্তাল পদ্মা নদীতে চলছে নৌবিহার

শাহানুর রহমান রানা (রাজশাহী ব্যুরো)

১৭ আগস্ট ২০২৫, ২১:৪৬ পিএম

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

রাজশাহী মহানগরীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট বলে বিবেচিত পদ্মানদীর পাড়। ভরা মৌসুমে পদ্মা নদী সংলগ্ন বেশকয়েকটি পয়েন্টে প্রতিদিন ঘুরতে আসে হাজার হাজার দর্শনার্থী ও ভ্রমণপিপাসুরা। তাদের মধ্যে অনেকেই পরিবার-স্বজন ও সহপাঠি নিয়ে নৌকায় চড়ে ঘুরতে যান পদ্মা নদীর বক্ষে। ভরা মৌসুমের উত্তাল পদ্মায় লাইফ জ্যাকেট ছাড়া নৌকা ভ্রমণ মানেই ‘জীবনের ঝুঁকি নেয়া’ বলে মন্তব্য স্থানীয়দের। পদ্মা নদীতে ‘নৌ-দূর্ঘটনার সাথে যোগ হওয়া মৃত্যুর মিছিলের বিগত সময়ের একাধিক ইতিহাস সেটিই বলে। নৌ-ভ্রমণের ক্ষেত্রে মাঝারি ও বড় আকৃতির ট্যুরিস্ট নৌকাগুলোর একাংশে লাইফ জ্যাকেটের উপস্থিতি থাকলেও ব্যবহারে নেই আগ্রহ। এমনও নৌকা চোখে পড়ে যেগুলোতে নেই একটিও লাইফ জ্যাকেট। নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে ক্রমান্বয়ের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে অনিরাপদ নৌকার। ট্যুরিস্ট পুলিশের তদারকির অভাবেই ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল পদ্মায় চলছে ঝুঁকিপূর্ণ নৌ-বিহার বলে মন্তব্য স্থানীয়দের।

প্রতিবছরই এই পদ্মা নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। বিগত সময়ের  ইতিহাস তেমনটাই বলে। বিয়ের বাড়ি থেকে ফেরার সময় নৌকা ডুবিতে সাতজনের মৃত্যুসহ অনেক যাত্রী নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে এই পদ্মায়। কয়েকঘন্টার ব্যবধানে দুটো নৌকা ডুবির ঘটনাও আছে এই নদীতে। এছাড়াও আছে ১৬ জন শ্রমিক নিয়ে ফেরার পথে নৌকা ডুবিতে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা। ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে আরো আছে, ‘এআইইউবি’র দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুসহ পানিতে ডুবে একইসাথে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনাও। নৌ দুর্ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা হয়, মেলে নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করাসহ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস। কিন্তু দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সবকিছু মিলিয়ে যায় সেই আগের মতোই বলে মন্তব্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন জেলা কর্মকর্তার।

নৌ-ভ্রমণে লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক হলেও মাঝিসহ যাত্রী ও ট্যুরিস্টরা মানছেনা সেই বাধ্যবাধকতা। যার কারণে নৌ-দূর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকেইে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে প্রায়শই সৃষ্ট হওয়া ছোট ও মাঝারি আকৃতির পাক, স্রোতের বেগ আর পানির প্রবল টানের কারণে যৎসামান্য অবহেলা আর খামখেয়ালীপনার কারণে মুহুর্তেই যাত্রী বোঝাই নৌকা হারাতে পারে নিজের নিয়ন্ত্রণ। অর্থ উপার্জনের জন্য ভরা মৌসুমে উত্তাল পদ্মায় অপরিপক্ক হাতে নৌকার হাল ধরার বিষয়টিও নৌকা ডুবির অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার স্থানীয়দের। এছাড়াও নৌবিহারে যাত্রীদের হইহুল্লোড়, নাচানাচি আর সেলফি তোলার জন্য অতিরিক্ত নড়াচড়ার কারণেও ‘নৌ-দূর্ঘটনা’ ঘটে বলে মন্তব্য অনেকের।


ট্যুরিস্ট পুলিশ রাজশাহী জোনের এসআই জাবেদ মাসুদ বলেন, উত্তাল পদ্মার বড় বড় ঢেউ দেখার পরেও পর্যটকরা অনিরাপদ পন্থায় নদীতে ভ্রমন করতে যাচ্ছে, বিষয়টি অসচেতনতা। আমরা যতদূর সম্ভব পর্যবেক্ষনে রাখি। নিষেধ করলেও কেউ শোনেনা। আইন বা বিধি নিষেধ অমান্য করলে আইন প্রয়োগ করার কোন অপশন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের গ্ৰেফতার করার কোন এফতিয়ার নেই। এবিষয়ে নৌ-পুলিশের কোন দায়বদ্ধতা আছে কিনা জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের এসআই জাবেদ মাসুদ বলেন, বিধি নিষেধ অমান্য করে নদীতে ভ্রমন করলে টহলরত নৌ-পুলিশ এ্যাকশনে যেতে পারবে।

জানতে চাইলে নৌ-পুলিশের এসপি রুহুল কবির খান বলেন, বিষয়টি ট্যুরিস্ট পুলিশের কাজ। বিষয়টি তারা দেখবেন। আপনি যেহেতু বললেন তাই এঠন থেকে বিষয়টির প্রতি আমরা নজর রাখবো বলেও জানান এসপি রুহুল কবির।

রাজশাহী নগরীর টি-বাঁধ (পাউবো কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে বর্তমানে প্রবেশ নিষিদ্ধ )-বুলনপুর-আলুপট্টি ও মুন্নুজান নদীর ধার সহ শহরের কয়েকটি পয়েন্ট ঘুরে দেখাগেছে, নদীর কিনারায় সারিবদ্ধভাবে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে নানা রংয়ে রাঙানো সুসজ্জিত নৌকা সহ সাধারণ মানের নৌকা। অপেক্ষা করছে পর্যটকদের জন্য। কেউ হাকডাক দিয়ে বলছেন, ‘বর্ডার যাবেন বর্ডার..’, কেউ ডাকছে ‘নৌকায় ঘুরতে যাবে কে কে, আসুন মামা আমার নৌকায় চড়ুন; একবার ঘুরে আসতে জনপ্রতি মাত্র পঞ্চাশ/একশ টাকা; আসেন মামা ওপার থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি’। অনেকেই পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধব নিয়ে উঠছেন নৌকাগুলোতে। যাত্রীদের বিপরীতে নৌকাগুলোতে সংরক্ষিত লাইফ জ্যাকেটের সংখ্যা কত; কিংবা লাইফ জ্যাকেট আদো আছে কিনা এসব চিন্তাভাবনা না করেই ভ্রমণের আকাঙ্খা জেঁকে বসে ভ্রমনপিপাসুদের মনে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট শিশু ও মহিলা-বৃদ্ধ নিয়েই উঠে পড়ছেন ভ্রমনপিপাসুরা।

কয়েকটি নৌকাতে লক্ষ্য করা গেছে তাদের সংরক্ষণে আছে সর্বোচ্চ ছয় থেকে আটটি লাইফ জ্যাকেট। নৌকার আকারভেদে প্রতিটিতে রয়েছে ষোল থেকে চব্বিশটি করে আসন। নৌকার মাঝি (চালক) ও সহকারির বক্তব্য মতে, কাস্টামারের চাঁপ কিছুটা বেশি থাকলে চব্বিশ আসন বিশিষ্ট নৌকাগুলোতে তারা চল্লিশ-পঞ্চাশজন করেও যাত্রী নিয়ে নদীতে ঘুরতে অভ্যস্ত ! অধিকাংশ নৌকাতে দেখাগেছে লাইফ জ্যাকেটের সংখ্যা মাত্র তিন-চারটি। আবার এমনও দেখাগেছে, নৌকার মাঝি ও তার সহোযোগী ব্যতীত ১৬ জন যাত্রী নিয়ে নদীতে ঘুরতে যাওয়া নৌকাটিতে লাইফ জ্যাকেটের সংখ্যা মাত্র দুইটি! ক্রমান্বয়ে পদ্মার পানি বিপদসীমার নিকটে ধাবিত হচ্ছে বিধায় পানি উন্নয়ন বোর্ড সম্ভাব্য দূর্ঘটনা এড়াতে ‘টি-বাঁধ’ এলাকায় দর্শনার্থী ও পর্যটকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করায়; ঠিক তার পার্শ্ববর্তী বুলনপুর এলাকাসহ শহরেরস্থানে অস্থায়ীভাবে তৈরি হয়েছে ভ্রমনপয়েন্ট। শহেরর বেশকয়েকটি পয়েন্ট ঘুরে দেখাগেছে, লাইফ জ্যাকেট ও অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম সংরক্ষণে রাখাতো দূরের কথা নৌকার ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। ‘টি-বাঁধ’ বন্ধ থাকার কারণেই শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছে ফিটনেসবিহীন নৌকা বলে জানান নদীরপাড় ঘেষা স্থানীয়দের।

 

পদ্মা নদীতে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার মধ্যে অন্যতম হল, ২০২৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে পদ্মা নদীতে নৌকা ডুবে চারজন নিখোঁজ হয়েছিলেন। নদীতে প্রচন্ড স্রোত থাকায় কয়েক ঘন্টার অভিযান শেষে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী দফতরের ডুবুরি ইউনিট। পরেরদিন ২ সেপ্টেম্বর দুই দফায় দুটো করে মোট চারটি লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল। ঐদূর্ঘটনায় পবা উপজেলার চর মাজারদিয়াড় গ্রামের এনামুল হকের ছেলে রাজু (২২), এন্তাজুল হকের ছেলে সবুজ (২০), আবুল কালামের ছেলে ফারুক (১৯) ও খলিলের ছেলে মোহাম্মদ আলী (৩৮) মৃত্যুবরণ করেন।

২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নগরীর তালাইমারী পয়েন্টে পরপর দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় অনেকে নিখোঁজ ছিলেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ৪ জনের তথ্য পেলেও অন্যটিতে কতজন যাত্রী ছিল তা নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। একই বছরের ১৪ নভেম্বর (২০২২) পদ্মা নদীতে নৌকা ডুবে দুই নারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া দুই নারীর বাড়ি পবা উপজেলার সোনাইকান্দি গ্রামে। একজন আলম হোসেনের স্ত্রী রাশেদা বিবি (৪৫) ও অন্যজন সুমন হোসেনের স্ত্রী আছিয়া বেগম ওরফে আসেনুর (৫০)।

২০২০ সালের ৬ মার্চ পদ্মা দুটি নৌকায় ৪০ জনের অধিক যাত্রী নিয়ে বরের লোকজন কনেকে আনতে যায়। সন্ধ্যার দিকে লোকজন নিয়ে দুটি নৌকা পদ্মা নদী দিয়ে ডাঙ্গের হাট ফিরছিল। মাঝ নদীতে পৌঁছালে নৌকা দুটি ডুবে যায়। ঘটনা ও উদ্ধার অভিযান শেষে মেয়ের পরিবারের দাবি ছিল, ঐ দূর্ঘটনায় প্রায় ৩০/৩৫ জনের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর (২০২০) ১৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা পদ্মা নদীতে ডুবে যায়। দুর্ঘটনায় ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি)’র বিবিএ তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম সূচনা ও তার চাচাতো ভাই রিমন নিখোঁজ হন। ঘটনার সাতদিন পর পদ্মায় তাদের দু’জনের মরদেহ ভেসে ওঠে। ২০১৭ সালের মে মাসে মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে পদ্মায় ডুবে মারা যান পাঁচজন।  

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.