ছবি: সংগৃহীত
. কেমন আছেন নিহত তিন যুবকের পরিবার?
. দিবসেই শুধু কদর বাড়ে তাদের!
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট এই দিনে ফুলবাড়ী কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলনের এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে আন্দোলনকারি ওপর তৎকালিন বিডিআরের গুলিতে নিহত হন এক কলেজ ছাত্রসহ কর্মজীবী তিন যুবক।
নিহত তিন যুবকের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তাদের মা-বাবা-ভাইবোনসহ পরিবারগুলো। কেমন আছেন তারা? প্রথম প্রথম তাদের খোঁজখবর নেওয়া হলেও এখন আর তেমন কেউ খোঁজ রাখেন না। শুধুমাত্র ২৬ আগস্ট খনিবিরোধী ট্র্যাজেডি দিবসেই নিহতদের পরিবারগুলোর কদর বাড়ে।
একই অবস্থার শিকার আহত হয়ে দুর্বিসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা গুলিবিদ্ধসহ আহত দু’শতাধিক নারী ও পুরুষেরও। ইতোমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারি প্রদীপ সরকার পরলোক গমন করেছেন। অপর গুলিবিদ্ধ বাবলু রায় এখন অসহনীয় মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
নিহতদের মধ্যে রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তরিকুল ইসলাম সম্ভ্রান্ত পরিবারের হলেও অন্য দু’জন আমিন ও সালেকিন ছিলেন হতদরিদ্র ও অসহায় দিনমজুর পরিবারের ছেলে। তরিকুল শিক্ষার্থী থাকলেও আমিন ও সালেকিন ছিলেন তাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কর্মজীবী যুবক। আমিন ও সালেকিনকে হারিয়ে তাদের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যে শহীদ তরিকুল ইসলামের পিতা শিক্ষক ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর মোকলেছার রহমান মৃত্যু বরণ করেছেন।
কেমন আছে আমিনের পরিবার?
ফুলবাড়ী পৌরএলাকার বারোকোনা গ্রামের দিনমজুর আব্দুল হামিদের ছেলে আমিনুল ইসলাম। চার ভাইবোনের মধ্যে আমিন বড়। ছোটবোন হানিফা বেগম, ছোটভাই আল আমিন ও সর্বকনিষ্ঠ বোন হুমাইরা আফরিন। আমিন পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি।
বাবার পাশাপাশি তিনিও সংসারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ২০০৬ সালে আমিনের বয়স ছিল ১৪ বছর। দেশের মাটি রক্ষার্থে সকলের মতো আমিনও বাড়ী থেকে মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে মিছিলে বেড়িয়ে পড়েন। মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু হলে দুর্ভাগ্যক্রমে আমিনের শরীর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আমিন।
আমিন মারা যাওয়ার পর ধারদেনা করে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে বাবা-মা। আমিনের মা রেহেনা খাতুন বলেন, আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আমাদের এতো কষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো না। ছেলের আয়ে অন্তত তিনবেলা পেটে ভাত জুটতো। প্রথম প্রথম খোঁজখবর নেওয়া হলেও এখন আর কেউ তেমন খোঁজখবর রাখে না। ২৬ আগস্ট নিজ উদ্যোগে নিহত ছেলের আমিনের জন্য বাড়ীতে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন তারা।
কেমন আছে সালেকিনের পরিবার?
নবাবগঞ্জ উপজেলার উত্তর শাহাবাজপুর গ্রামের ঝোড়ারপাড়া গ্রামের হাসান আলী ও শেফালী বেগমের ছেলে সালেকিন। পাঁচভাইবোনের মধ্যে সালেকিন তৃতীয়। সালেকিনের বাবা হাসেন আলী কৃষিশ্রমিক। ২০০৬ সালে সালেকিন সবে প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক জীবন শুরু করেছিল।
গ্রামের সবাইকে আন্দোলনে যেতে দেখে সালেকিনও উৎসাহিত হয়ে গ্রামের মিছিলে বেরিয়ে পড়েন ফুলবাড়ীর দিকে। চাচা জোবেদ আলীর সাথে ফুলবাড়ী আসলেও পরবর্তীতে দুলাভাইয়ের সাথে আন্দোলনে থাকেন। চারিদিকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে সেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সালেকিন।
সালেকিনের মা শেফালী বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, স্কুল থেকে ফিরেই না খেয়েই মিছিলে ঢুকে ফুলবাড়ীতে চলে যায় সালেকিন। তাকে অসংখ্যবার বললাম সেখানে গন্ডগোল হবে যাস না। কিন্তু তবুও সে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়ে। আমি পথ চেয়ে রইলাম। সালেকিন বাড়ী ফিরল ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। ২৬শে আগস্ট আসলেই আমাদের খোঁজখবর নেয়া হয়। সালেকিন মারা যাওয়ার পর অনেকে সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বৃদ্ধ অসুস্থ স্বামী হাসান আলী বিছানায় পড়ে যাওয়ায় এখন তাদেরকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে হচ্ছে।
কেমন আছে তরিকুলের পরিবার?
ফুলবাড়ী পৌরএলাকার উত্তর সুজাপুর (চাঁদপাড়া) গ্রামের সাবেক পৌর কাউন্সিলর ও শিক্ষক মরহুম মোকলেছুর রহমানের ছেলে আবু সালেহ তরিকুল ইসলাম। তিনভাইয়ের মধ্যে তরিকুল ছিলেন বড়। তার ছোটভাই সাদ্দাম হোসেন ও তৌকির আহম্মেদ তপু। তরিকুল রাজশাহীর নিউ গর্ভমেন্ট কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তরিকুল তার ছোটভাই সাদ্দামকে নিয়ে আন্দোলন দেখতে ফুলবাড়ী বাসষ্ট্যাণ্ড এলাকায় যান।
সাদ্দাম জীবিত ফিরলেও তরিকুল ফিরেন লাশ হয়ে। তৎকালীন বিডিআরের গুলিতে প্রাণ হারান মেধাবী ছাত্র তরিকুল ইসলাম। তরিকুলের পরিবারের লোকজন জানান, সেদিন দুপুরে দুইছেলে ফুলবাড়ী পৌরশহরে বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় আন্দোলন দেখতে যায়। বিকালে পিতা মোকলেছার রহমানের কাছে ফোন আসে বিডিআরের গুলিতে তরিকুল মারা গেছে। পরদিন দিনাজপুর থেকে তার মরদেহ আনা হয়। তার শূন্যতা নিয়েই পরিবারের মা-ভাইবোন বেঁচে আছেন।
এদিকে সন্তান হারা পরিবারগুলো সন্তানের শূন্যতায় পড়েছে। সন্তানের স্মৃতি আর চোখের জল তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারগুলোর দাবি: প্রতিবছর ২৬শে আগস্ট শুধুই দিবসে পরিণত হলেও, সন্তানহারা পরিবারগুলো খোঁজখবর নেওয়ার যেনো কেউ নেই। সন্তানদের কথা মনে পড়লে যেনো তাদের জীবনে কালো মেঘে ছেয়ে নেমে আসে। সন্তানরা পরিবারগুলো নিহত সন্তানদের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছেন।
খনি বিরোধী আন্দোলনের ফুলবাড়ী শাখা তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল ও সদস্য সচিব জয় প্রকাশ গুপ্ত বলেন, নিহত আমিন ও সালেকিনের পরিবারকে সাধ্যমত সহযোগিতা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের। তবে প্রথম থেকেই তরিকুলের পরিবার কোনো প্রকার সহযোগিতা নেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh