× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ট্রলার চালক থেকে শতকোটি টাকার মালিক আ.লীগ নেতা

আশিকুর রহমান হৃদয়, শরীয়তপুর

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:২২ পিএম

মাত্র ২০ বছর বয়সে পরিবারের অভাব ঘুচাতে বাবার সঙ্গে ট্রলারের সুকান ধরে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন আব্দুল মান্নান হাওলাদার। এরপর দীর্ঘদিন ট্রলার চালক হিসেবে যাত্রীদের সেবা দিয়ে স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি পান ট্রলার মান্নান হিসেবে। ট্রলার দিয়ে অবৈধ মালামাল পরিবহন করে কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে এলে আ.লীগের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

এরপর ট্রলার মান্নান শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু এখনও তিনি এলাকায় ট্রলার মান্নান হিসেবেই পরিচিত।

স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভেদরগঞ্জ পৌরসভার গৈড্যা এলাকার গরীব ট্রলার চালক আব্দুল রহমান হাওলাদার ও হায়তুন নেছা দম্পত্তির ১৯৭০ সালে জন্ম নেওয়া ছেলে আবদুল মান্নান হাওলাদারের শৈশব ও যৌবন কেটেছে নিদারুণ অর্থ কষ্টে। পারিবারিক অভাব অনটনে বাবার সঙ্গে ট্রলার চালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ট্রলার যোগে ভেদরগঞ্জ থেকে যাত্রী নিয়ে নড়িয়ার সুরেশ্বর লঞ্চে পাড়াপাড় করতেন তিনি। এসময় মান্নান ট্রলার মান্নান হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরপর ১৯৯৬ সালে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

যোগদানের কিছুদিন পরেই তিনি উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হোন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। যেন আলাদীনের চেরাগ একের পর এক সফলতা এনে দিয়েছে তাকে। যুবলীগের সভাপতি হয়ে কমিটিতে পদ বাণিজ্য করে প্রথম টাকার মুখ দেখেন মান্নান।

২০১১ সালে ভেদরগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আ.লীগ প্রার্থী আব্দুল হাই বেপারীকে সমর্থন না দিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হন আব্দুল মান্নান হাওলাদার। প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হয়ে মান্নান ভেদরগঞ্জ পৌরসভা আ.লীগের রাজনীতিতে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

মেয়র হয়ে আব্দুল মান্নান হাওলাদার হয়ে ওঠেন দখলদার, চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ। মেসার্স উর্মী এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে টেন্ডারবাজি করে হাতিয়ে নেন সরকারি খাতের কোটি কোটি টাকা। শুধু টেন্ডারবাজিই নয় দখল ও চাঁদাবাজিও ছিল তার অন্যতম আয়ের উৎস। তিনি

ভেদরগঞ্জ বাজারের মডেল মসজিদের পাশে  সরকারি খাস জমি দখল করে দোকান নির্মাণ করেছেন। ভেদরগঞ্জ পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের পাশে নদী জায়গায় দখল করে মার্কেট ও ২০ টি দোকান নির্মাণ করেছেন। উপজেলার সুর্য মনি এলাকায় প্রায় ৫০ বিঘা জমি রয়েছে তার, যার বাজার মূল্য ২ কোটি টাকা। রাজধানীর মিরপুরে দুটি ফ্ল্যাট।  এছাড়াও নামে বেনামে একাধিক জমি ফ্লাট, প্লট ও জমি রয়েছে মান্নান হাওলাদারের।

ভেদরগঞ্জ হেট কোয়ার্টার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও মান্নান তার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা বিদেশে। তার ১ ছেলে ও ১ মেয়ে পড়াশোনা করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে ছুটিতে এসে ২ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার ছেলে।

নির্বাচনী হলফনামায়ও মান্নান হাওলাদার কোটি টাকার মূল্যের সম্পদের মালিক। হলফনামা অনুযায়ী মান্নান হাওলাদারের কৃষি জমি থেকে বছরে আয় ২০ হাজার টাকা। বাড়ি বা দোকান ভাড়া থেকে ৫ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা। 

ঠিকাদারি থেকে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪৮ টাকা, ফার্ম থেকে ৬০ হাজার টাকা, এফডিআর থেকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫৬৮ টাকা, মেয়র ভাতা পান ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, পারিবারিক অন্যান্য উৎস থেকে ৩৩ হাজার ৩৩০ টাকা। এছাড়াও হলফনামায় মান্নান হাওলাদারের নগদ টাকা ছিল ১ লাখ। ব্যাংকে জমা ছিল ৫ লাখ টাকা। প্রাইভেট ক্লিনিকে শেয়ার ছিল ৫ লাখ টাকার। এফডিআর ছিল ৫০ লাখ টাকা, মোটরসাইকেল ১ টি, ট্রলার ১ টি,

স্বর্ন অলংকার নিজ নাম ছিল ১ ভরি। তার স্ত্রীর নগদ টাকা ছিল ৫০ হাজার। ব্যাংকে ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রাইভেট কার ছিল ১ টি। স্বর্ন গয়না ছিল ৭ ভরি, কৃষি জমি ছিল ৭ দশমিক ১৭ একর, অকৃষি ৩০ শতাংশ, আবাসিক দালান বাড়ী ২ টি, নির্মাণধীন বাড়ী ছিল ১টি।

জ্ঞাত-অজ্ঞাত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা আব্দুল মান্নান হাওলাদার এক সময় টাকার অভাবে ট্রলার চালক ছিল। তা এ প্রজন্মের কেউ বিশ্বাসই করবে না। ট্রলার মান্নানের এত সম্পদ নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে স্থানীয়দের মধ্যে উঠেছে ব্যাপক গুঞ্জন। এখন পর্যন্ত আব্দুল মান্নান হাওলাদারের বিরুদ্ধে হত্যা সহ তিনটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। গত জুলাই আন্দোলনে ছাত্রজনতার উপর হামলার ঘটনা রাজধানীর আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে।

মামলা নং ১৭ /২৫ -২০২৪। এছাড়াও মারামারি সহ ভেদরগঞ্জ থানায় আরও দুটি মামলা রয়েছে। গত ৫ আগষ্টের পর থেকে আব্দুল মান্নান পলাতক রয়েছে।আব্দুল মান্নান হাওলাদারের সাথে একই ঘাটে ট্রলার চালাতেন তৈয়ব আলী। প্রায় ৪০ বছর ধরে ট্রলার চালাচ্ছেন তিনি। শনিবার বিকেলে উপজেলা চত্বরে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন,“ একসময় আব্দুল মান্নানের সাথে একি ঘাটে ট্রলার চালাতাম।  তার ভাগ্য বদলে গেছে ঠিকই। আমি ৪০ বছর ধরে চালাচ্ছি এখনো নিজের টাকায় বাড়ি পর্যন্ত করতে পারি নি।

আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে রাতারাতি এখন তার এত সম্পদ! কয়েক বছরে কিভাবে শত কোটি টাকার মালিক হলো এটা আমাদের বোধগম্য নয়।”মো. রাজিব প্রায় ৩০ বছর ধরে চা বিক্রি করছেন ভেদরগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে। রবিবার সকালে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন,“ একসময় আমাদের এই ঘাট থেকে সুরেশ্বর লঞ্চ ঘাটে ট্রলারে মানুষ যাতায়াত করতো। সেসময় মান্নান ভাই ট্রলার চালক ছিলেন এবং তার বাবার সাথে নিয়মিত লাইনে ট্রলার চালাতেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে মান্নান ভাই এখন এলাকায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। আগে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাথেই মিশতেন। কিন্তু এখন তার সাথে দেখা পাওয়াও কঠিন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে তিনি এলাকা ছেলে পালিয়ে আত্মগোপনে আছেন। আমরা অবাক হলাম একজন মানুষ রাজনীতি করে এতো টাকা কিভাবে ইনকাম করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মান্নান হাওলাদারের এক আত্মীয় বলেন,“রাজনীতির ক্ষমতা আর ব্যবসার দাপটে তিনি অনেক সম্পদ করেছেন। এই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন আছে। মান্নান ভাই আগে কষ্ট করে সংসার চালাতেন এখন তার বড় বাড়ি, কোটি কোটি টাকার জমি, গাড়ি সব আছে। আমরা অবাক হই এত অল্প সময়ে এত কিছু কিভাবে হলো। ওনি মেয়র হওয়ার পরে তার ভাগ্য আরও খুলে যায়। আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে জোরপূর্বক মানুষের জমি দখল, সরকারি জমি দখল এছাড়াও এলাকার মানুষকে তিনি নানান ভাবে হয়রানি করছে।”

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে তার ভেদরগঞ্জের বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায় নি। তার ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিক বার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। ভেদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুল হাসান বলেন,”এপর্যন্ত তার বিরুদ্ধে রাজধানীর আদাবর থানায় হত্যা মামলা সহ ভেদরগঞ্জ থানায় আরও দুটি মারামারির মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.