রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বৃহত্তর উপজেলা বাঘাইছড়ি। বাঘাইছড়ি উপজেলায় ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এক সময় স্থানীয় জনগণের জন্য চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি যেন নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাব এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি কার্যত ধুঁকে ধুঁকে চলছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য তারা প্রায়ই চরম দুর্ভোগের শিকার হন। যারা শারীরিকভাবে দুর্বল এবং আর্থিকভাবে দরিদ্র, তাদের জন্য এই দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে না, বরং এই অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকিকেও বাড়াচ্ছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চিকিৎসক সংকট। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ১৬টি চিকিৎসক পদের মধ্যে মাত্র ৩ জন চিকিৎসক নিয়মিত কর্মরত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বছরের পর বছর ধরে নিঃসঙ্গ। ফলে প্রতিদিনের রোগী সেবা অত্যন্ত সীমিত ও অপর্যাপ্ত।
অন্যদিকে গাইনী ডাক্তারের পদটি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। বিশেষ করে গাইনী ডাক্তার না থাকায় এখানকার গর্ভবতী মায়েদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। প্রসবের সময় জরুরি প্রয়োজনেও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গাইনী ডাক্তারের জায়গায় চিকিৎসা দিচ্ছেন অন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। আবার সামান্য জটিলতা দেখা দিলে তাদের খাগড়াছড়ি বা চট্টগ্রাম হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে করে অনেক সময় পথেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে।
একজন স্বাস্থ্যকর্মী, যিনি নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, আমরা সীমিত জনবল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। সকালে ওয়ার্ড ভিজিট শেষ করে আউটডোর এ বসতে হয়, আবার এর মধ্যে ইমার্জেন্সি রোগী আসলে আউটডোরের রোগী রেখে ওখানে যেতে হয়। এক কথায় একজন ডাক্তারকে একাধিক রোগীর দায়িত্ব সামলাতে হয়, যা মানসম্মত সেবা দেওয়াকে অসম্ভব করে তোলে। আবার অন্য দিকে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় গুরুতর রোগীও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রেফার করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
চিকিৎসক সংকট শুধু রোগীদের উপর নয়, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরও চাপ বাড়াচ্ছে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এছাড়াও, চিকিৎসা দলের মধ্যে জুনিয়র ডাক্তার ও নার্সদের অভাবও লক্ষণীয়। অনেক সময় রোগীরা সাধারণ অসুস্থতার জন্যও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। শিশু ও বয়স্ক রোগীদের জন্য এটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করে, কারণ প্রাথমিক চিকিৎসা পেতে না পারলে তাদের অবস্থা জটিল হয়ে যায়।
বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবও চরম। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। ফলে রোগীরা পরীক্ষা করানোর জন্য বাইরে বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হন, যা দরিদ্র পরিবারের জন্য অর্থনৈতিকভাবে খুবই কঠিন। এছাড়াও আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন থাকলেও এটা পরিপূরক নয়, মেশিনে শুধু দেখা যায়, তবে রিপোর্ট দেওয়া যায় না।
হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংক এর কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে জরুরি প্রয়োজনে যেমন- কোনো দুর্ঘটনায় আহত রোগী বা প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ হলে রক্ত দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীকে শুধুমাত্র রক্তের অভাবে বাঁচানো যায় না। স্থানীয়রা বলছেন, এমন অবস্থায় তাদের নিজেদেরই রক্ত জোগাড় করতে হয়, যা অনেক সময় সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই সেবা না থাকায় রোগীদের বাইরের বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়, যেখানে তাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়।
এফ ব্লক গ্রামের একজন গৃহিণী বলেন, আমার সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয় কোন পর্যাপ্ত সেবা। এখানে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করলে যে রিপোর্ট আসে তা আবার চট্টগ্রাম বা খাগড়াছড়ির রিপোর্টের সাথে মিলে না। আর হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার কোন ব্যবস্থাও নাই আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এছাড়াও ব্লাড কালেকশনের ও নেয় কোন ব্যবস্থা, যার কারণে অধিক টাকা ব্যয় হয় বাহির থেকে ক্রস মেস করতে গেলে। আমি আশা করি যদি এর কোন ব্যবস্থা হয় তাহলে আমার মতো আরো হাজারো মানুষের অনেক উপকার হবে।
পানি ডুবে যাওয়া রুগীর মামা তৈয়ব বলেন, আমার ভাগিনা পানিতে পরার সাথে সাথে অল্প সময়ের মধ্যে উদ্ধার করি, তবে সে ওই সময়ের মধ্যে পানি খেয়ে পেলে, আমরা তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তার অক্সিজেন দেওয়ার পর বলেন, ৫ মিনিট দেখেন যদি অস্বাভাবিক দেখেন তাহলে খাগড়াছড়ি নিয়ে যাবেন। এখন আমার কথা হলো, আমার ভাগিনা চোখ খুলে তাকাচ্ছে, বা নড়াচড়া করছে, তাহলে সে স্বাভাবিক কিছুটা অবনতিও হতে পারে। তাই বলে কি খাগড়াছড়ি নিতে হবে? তাহলে আর এখানে আমরা কি সেবা পেলাম? এই কি তাদের চিকিৎসা?
এক নার্স জানান, আমরা চাইলে রোগীদের সাহায্য করতে পারি না। অনেক সময় গুরুতর রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষা করতে হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে তাদের খাগড়াছড়ি বা চট্টগ্রাম হাসপাতালে পাঠাই।
অধিকাংশ রোগী ও স্বজন এই অভাবের কারণে হতাশ। একজন স্থানীয় বৃদ্ধ আবুল খায়ের বলেন, আমাদের এখানে চিকিৎসার সুবিধা নেই। ছোট ছোট অসুখও বড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালের পরিবেশও রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডের টয়লেটগুলো নোংরা এবং ব্যবহারের অনুপযোগী। এছাড়াও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের অনেকাংশ জরজীর্ণ, তবে এর উপরে করা হয়েছে রিপাইরিং।
এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করে বলেন, আমরা এখানে সুস্থ হতে এসেছি, কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে আরও অসুস্থ হয়ে যাব। টয়লেটগুলো ব্যবহার করা তো দূরের কথা, টয়লেটে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায়না, এতো পরিমাণ দুর্গন্ধ।
হাসপাতালের রিপেয়ারিং এর বিষয়ে এক স্থানীয় নারী বলেন, বেশ কিছুদিন আগে আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে আসি, তখন দেখি ছাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফেলেস্টার/আস্তর ভেঙ্গে ভেঙে পড়ছে। এর এবার এসে দেখি ভিন্ন! একই বারে যেন নতুন ভবন। ফ্লুরে টাইলস করা, চারদিকে রং করা ইত্যাদি। কিন্তু আমার কথা হলো এভাবে তালি জোড়া দিয়ে আর কত?
এছাড়াও হাসপাতালের চারপাশে পরিচ্ছন্নতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। যা থেকে ছড়াতে পারে নানান রোগ জীবাণু সহ ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বাড়তে পারে।
সরকারি ওষুধের সরবরাহও নিয়মিত নয় বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। রোগীদের অভিযোগ মাসের অর্ধেক এ গিয়ে আর তেমন ওষুধ পাওয়া যায় না, প্রায়ই বাহিরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে বলা হয়। এতে দরিদ্র রোগীরা আর্থিকভাবে ভুগছেন।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, মাসের অর্ধেকে ডাক্তার দেখাতে আসলে প্রয়োজন মতো ওষুধ পায় না, বলে দেয় বাহির থেকে কেনার জন্য। তাহলে আমরা আর কোথায় সরকারি হাসপাতালের সেবা পেলাম?
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এই স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশায় খুবই হতাশ।
জনগণের আরও দাবি, হাসপাতাল পরিচালনায় স্বচ্ছতা, নিয়মিত সরঞ্জাম ও ওষুধ সরবরাহ, এবং পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করা হোক। এছাড়া পরিচ্ছন্নতা ও রোগী সেবা মান উন্নয়নের জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
এ বিষয়ে রাঙামাটি সিভিল সার্জন ডা. নুয়েন খীসা বলেন, আমি ডাক্তার সংকটের বিষয়ে অবগত, তবে এখন উর্ধগণ কর্মকর্তা যদি এখানে কাউকে পদায়ন না করে, তাহলে আমার আর কিছুই করার থাকে না। তবে আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি এই সমস্যা সমাধানের।
আর এক্স - রে কিংবা অন্যান্য মেশিনারী পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয়ে যদি বলতে যায়, তাহলে আগে ভাবতে হবে আমাদের বিদ্যুৎ নিয়ে। বাঘাইছড়িতে বিদ্যুতের সমস্যাটা আগে থেকেই, তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি শুধু মাত্র যাতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লাইনটা যেন আলাদা করা যায়। এতে করে পরবর্তীতে আমাদের বেগ পেতে হবে না। আর এই বিদ্যুতের সমস্যার কারণে এক্স রে মেশিন ব্যবহার না হওয়ায় এটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ব্ল্যাড ব্যাংক নিয়ে তিনি বলেন, ব্লাড ব্যাংক করা অনেক সিস্টেমিক ব্যাপার - উপজেলা পর্যায়ে ব্লাড ব্যাংক হুট করে চাইলেও করা যায় না, তবে ক্রস মেস এর ক্ষেত্রে আমার মনে হয় সেখানে করা যাবে।
সর্বশেষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর পূর্ণনির্মান নিয়ে বলেন, আসলে এই বিষয়টা সম্পূর্ণ আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর উপরে, উনারা কাজ শুরু করলে সেটা দেখা শুনার দায়িত্ব থাকে আমাদের। তবে আমি এই বিষয়ে দায় এড়াবো , আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি সেটা বাস্তবায়ন করার। আমি নিজেই একজন বাঘাইছড়ির সন্তান হিসেবে আমি এখানে দায়িত্বে থাকা কালীন যদি এই সমস্যা গুলো অনেকটা সমাধান করতে পারলে সেটা হবে আমার জন্য গর্বের।
বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান পরিস্থিতি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার ফল। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব, আধুনিক সরঞ্জামের ঘাটতি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাব এবং দুর্নীতি একসাথে মিলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
ঊর্ধগণ কর্মকর্তা যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই এলাকার হাজার হাজার মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, পর্যাপ্ত ওষুধ বিতরণ এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করলে এখানকার স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো সম্ভব।
স্থানীয়রা আশা করছেন, সরকারের কার্যকর উদ্যোগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঠিক মনোযোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সকে আবারও জনগণের ভরসাস্থলে পরিণত করা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করা না হলে শুধুমাত্র রোগী নয়, পুরো এলাকার জনস্বাস্থ্যই সংকটের মুখে পড়বে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh