ছবি: সংবাদ সারাবেলা।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ও গোমরা এলাকার পাশ দিয়ে খাইঞ্জার হাওর, বিন্নার হাওরসহ আশপাশের ছোট বড় হাওর মিলিত হয়েছে তিন উপজেলা বিস্তৃত বৃহত্তম হাইল হাওরে। এক সময়ে এ হাওরগুলো কৃষি আর মিঠা পানির দেশীয় মাছের জন্য এ জনপদের মানুষের কাছে বিখ্যাত ছিলো। গোলা ভরা ধান আর হাওর ভরা মাছ এখন কেবল ইতিহাসের পাতায়। কালের বিবর্তনে বাস্তবে হারাতে যাচ্ছে হাওরের ঐতিহ্য। দুষণ, নাব্যতা সংকট আর জলজটে তিন ফসলী জমি এখন এক ফসল করাই দায়। অস্তিত্ব বিলিনের পথে দেশীয় মাছ। তাতে অব্যাহতভাবে হুমকির মুখে হাওর পরিবেশ, জীববৈচিত্র আর হাওর কেন্দ্রীক অগণিত কৃষকের স্বপ্ন।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, শহরতলীর গোমরা এলাকার বিসিক শিল্প নগরীর অন্তত ৩৫ থেকে ৩৬টি শিল্প কারখানার বর্জ্য ও বিষাক্ত কেমিক্যালের বর্জ্য ড্রেন দিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে হাওরে। সেই সাথে পুরো মৌলভীবাজার শহরের বর্জ্য কোদালীছড়া দিয়ে হাওরে প্রবেশ করছে। এছাড়া জগন্নাথপুর এলাকার খাইঞ্জার হাওরে পৌরসভার ক্রয়কৃত জায়গায় নির্মিত ময়লার ডাম্পিং স্টেশনের বর্জ্যও সীমানা প্রাচীর না থাকায় ছড়িয়ে পড়ছে হাওরে। মিশে যাচ্ছে হাওরের পানিতে। এতে সৃষ্টি হওয়া দুর্গদ্ধে চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ও গোমড়া এলাকার স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দারা এ দুর্গন্ধে প্রায় অতিষ্ঠ। বছরের পর বছর জুড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করলেও কোন প্রতিকার মেলেনি, এ নিয়ে দায়ও নেই কোন কর্তৃপক্ষের, নিরব এখানকার পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তারাও। ময়লা-আবর্জনায় পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নাভিম্বাস ডাম্পিং স্টেশন আশপাশে বসবাসকারী কয়েক হাজার মানুষ। শুধু ডাম্পিং স্টেশনের বর্জ্য নয়, শহরের পলিথিন, প্লাস্টিক, হাসপাতাল বর্জ্য, বাসা-বাড়ি ও হোটেলের বর্জ্য কুদালিছড়া দিয়ে প্রতিনিয়ত হাওরে প্রবেশ করে একদম ছড়িয়ে পড়ছে জেলার বৃহত্তম মিঠা পানির হাওর হাইল হাওরে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা না মেনে পৌরসভার বর্জ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপগুলো শ্রীমঙ্গল সড়ক দিয়ে গন্তব্যস্থল জগন্নাথপুরের খাইঞ্জার হাওরের ডাম্পিং স্টেশনের পথে চলাচল করছে। এতে দুর্গন্ধে চলাচলকারী মানুষদের চরম দুর্ভোগে নাক চেপে চলতে হচ্ছে। এছাড়া চলতি পথে সড়কে যত্রতত্র বর্জ্য পড়ে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। জানা যায়, খাইঞ্জার হাওর জুড়ে কৃষকের ফসলী জমি, গৃহপালিত পশু ও মৎস ময়লার দুর্গন্ধে ক্ষয়-ক্ষতি বছরের পর বছর। এতে অনেক কৃষক হাওরের দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে নেমে আক্রান্ত হচ্ছেন চর্ম রোগে। মোস্তফাপুর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার কাছে লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি বলে জানিয়েছেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম তাজ।
খাইঞ্জার হাওরের কৃষক শফিক মিয়া জানান, বর্জ্যের কারণে চলাফেরা করতে পারিনা। ক্ষেত করতে গিয়ে ইনজেকশনের সুইচ ঢুকে যাচ্ছে পায়ে, তাতে হাত-পা কাটছে। ডাম্পিং স্টেশনের চারপাশে গাইডওয়াল না থাকায় বর্জ্য হাওরে ছড়িয়ে পড়ে পানিতে ভাসছে। তাতে নষ্ট হচ্ছে কৃষিক্ষেত। আগের মতো হাওরে মাছও মিলছেনা।
ডাম্পিং স্টেশনে মুন্না নামের এক শ্রমিক জানান, প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ টন বর্জ্য আসে। এগুলো অনেক সময় পিছনের অংশে সীমানা প্রাচীর না থাকায় বাহিরে ছড়িয়ে হাওরের সাথে মিশে যায়। আমরা চেষ্টা করছি যাতে বর্জ্যগুলো বাহিরে না যায়। গোমড়া এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, হাওরে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে চর্মসহ নানা রোগব্যাধিতে অনেকে আক্রান্ত হলেও কেউ এটা নিয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমরা কোথায় যাবো। কার কাছে প্রতিকার পাবো।
পৌর সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ ও ২০২২সালে পৌরসভার বর্জ্য/ময়লা ফেলার জন্য জগন্নাথপুর খাইঞ্জার হাওর এলাকায় দুই বারে ৪ দশমিক ৪১ একর ভুমি ক্রয় করে আধুনিক ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রকল্পের প্রায় ১০কোটি টাকার বরাদ্ধ আসলেও ডাম্পিং স্টেশনের রাস্তা ও চারিদিকে বাউন্ডারীসহ অন্যন্য কাজ সটিকভাবে করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে পৌর কর্তৃপক্ষ কাজ সম্পুর্ন করতে আরো অর্থ বরাদ্বের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে। মূলত পৌর নাগরিকদের ব্যবহৃত বর্জ্য দিয়ে সেখানে তৈরি হবে জৈব্যসার ও বায়োগ্যাস প্লান্ট।
মৌলভীবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, হাওরে বর্জ্য ফেলার কারণে বিসিকের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র নবায়ন বন্ধ রাখা হয়েছে আর পৌরসভার বর্জ্যে হাওর দুষিত হলেও আমাদের কিছু করার নেই। কারণ তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন অনুমোদন নেননি।
মৌলভীবাজার পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার সাহাদাত জানান, বর্জ্য যাতে বাহিরে ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেকারণে প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা আগেই পাঠানো হয়েছে। এটা চলতি অর্থ বছরে না হলেও আগামী অর্থ বছরে সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ওই প্রকল্পের আওতায় ডাম্পিং সেটশনের রাস্তা, সীমানা প্রাচীর সহ ডাম্পিং স্টেশনের অভ্যান্তরিণ উন্নয়ন শেষ হলে বর্জ্য আর বাহিরে ছড়িয়ে পড়বেনা। এ সমস্যা সমাধান হলে সমস্যাও থাকবেনা।
বিসিক শিল্প নগরী কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, বিসিক শিল্প নগরী কতৃপক্ষ আসলে বিষয়টি নিয়ে উভয় সংকটে আছে। কারণ সামনের ড্রেন দিয়ে হাওরে বর্জ্য ফেললে স্থানীয় লোকজনের আপত্তি আবার পিছনের ড্রেন দিয়ে বর্জ্য যাতে বাহিরে না যায় সেকারণে স্থানীয়রা চিঠি দিয়ে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। তবুও আমরা চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বর্জ্য অপসারণে নিজস্ব অটিপি চালু করে। কারখানা গুলো নিজস্ব অটিপি চালু করলে হাওরে বর্জ্য গিয়ে পড়ে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটা হয়তো কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh