বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল (ঙৎরবহঃধষ গধমঢ়রব জড়নরহ)। ছোট্ট কালো-সাদা পাখি, কিন্তু পরিচয়ে গর্বিত- জাতির প্রতীক, সংস্কৃতির অনুষঙ্গ, সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। একসময় ভোরের আকাশে দোয়েলের সুরেলা ডাক শুনেই ঘুম ভাঙত গ্রামের মানুষের। এখন সেই ডাক কেবল স্মৃতি। মানিকগঞ্জে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পাখি দোয়েল।
একসময় জেলার গ্রামাঞ্চলের মাঠ-ঘাট, ধানের জমি, গাছপালা, বাঁশঝাড় কিংবা বাড়ির ছাদে সহজেই চোখে পড়ত দোয়েলসহ নানা প্রজাতির দেশীয় পাখি। কিন্তু এখন দিনভর ঘুরেও খুব কম দেখা যায়। স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, কালের বিবর্তনে পাখির কলরবে মুখরিত গ্রামগুলো আজ নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সাটুরিয়া ও ঘিওর এলাকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতো দোয়েল, শালিক, চড়ুই, ঘুঘু বা মাছরাঙার উপস্থিতি নেই। কেবল মাঝে মধ্যে কাক বা কয়েকটি ঘুঘু দেখা যায়। ধানকোড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস বলেন,“আমাদের ছেলেবেলায় সকালে দোয়েলের গান শুনে ঘুম ভাঙত। এখন বাচ্চারা সেই পাখি চিনেই না। গাছ কমে গেছে, জমিতে কীটনাশক ব্যবহার বেড়েছে-তাই পাখিরা আর আসে না।”
অন্য এক প্রবীণ বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন,“আগে দুপুরে গাছের ছায়ায় বসলে পাখির কলরবে মন ভরে যেত। এখন গ্রামের আকাশ ফাঁকা, কান পেতে থাকলেও কোনো পাখির ডাক পাওয়া যায় না।”
স্থানীয় পরিবেশকর্মী জহিরুল ইসলাম বলেন,“দোয়েল শুধু একটা পাখি নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয়ের অংশ। কিন্তু আমরা নিজেরাই সেটিকে হারিয়ে ফেলছি। পরিবেশবান্ধব কৃষি ও বন সংরক্ষণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দোয়েল কেবল টাকায় আর বইয়ের পাতায় দেখবে।”
দোয়েল বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। এটি একসময় শহর থেকে গ্রাম- সব জায়গায়ই দেখা যেত। প্রকৃতিতে দোয়েল উপকারী পাখি; এটি বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। দোয়েলের মিষ্টি ডাক ও ছন্দময় চলাফেরায় গ্রামীণ জীবনে ছিল এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য।
১৯৭১ সালের পর দোয়েলকে বাংলাদেশের জাতীয় পাখি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এমনকি দুই টাকার কাগজের নোটেও জায়গা পেয়েছে এই পাখি। আজ সেই দোয়েল বাস্তবে আর চোখে পড়ে না।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন,“গ্রামীণ পরিবেশে পাখির উপস্থিতি টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। গাছ লাগানো, পাখি শিকার বন্ধ ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে। নাহলে জাতীয় পাখি হারানোর দায় আমাদেরই নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে দোয়েলসহ দেশীয় অনেক প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।” পরিবেশবাদীরা মনে করেন, পাখির আবাসস্থল রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামাঞ্চলে গাছ লাগানো, পাখির বাসা তৈরি, পাখি শিকার নিষিদ্ধকরণ এবং শিশুদের পাখি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিন বলেন,“নতুন প্রজন্ম এখন পাখি দেখে না, তারা চেনে না। তাই বিদ্যালয়ে পাখি সম্পর্কে পাঠ দেওয়া উচিত। এতে তারা প্রকৃতিপ্রেমী হবে।”
মানিকগঞ্জের গ্রামের আকাশে এখনো মাঝে মাঝে ভেসে আসে দূরের কোনো পাখির ডাক। কিন্তু সেই ডাক আর দোয়েলের নয়। জাতীয় পাখি হিসেবে যে দোয়েল একসময় আমাদের পরিচয়ের অংশ ছিল, এখন তা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এ যেন আমাদের প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের এক নীরব বিলাপ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh