× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

হাইব্রিডের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় জাতের ধান

মো. আবুল হাসেম, মাটিরাঙ্গা (খাগড়াছড়ি)

২১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৭ পিএম

হাড় কাঁপানো শীতের সকালে গ্রামের চুলোর পাশে বসে খেজুর রসের পিন্নি, দেশীয় নতুন চালের গরম ভাপা পিঠা খেতে খেতে খোশগল্প করার সেই দিনগুলো আজ কেবলই স্মৃতি। একসময় নতুন চালের পিঠাপুলি বানিয়ে জামাই দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো ছিল গ্রামীণ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য। কিন্তু কালের বিবর্তন, আধুনিকতার ছোঁয়া ও উন্নত প্রযুক্তির প্রভাবে আজ সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। দেশীয় ধানের সুবাসে ভরা পিঠাপুলির মৌসুম এখন শুধু স্মৃতিচারণেই সীমাবদ্ধ।

কৃষিব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যিক দাপটে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় জাতের ধান। অধিক ফলনের আশায় কৃষকরা ঝুঁকছেন হাইব্রিড জাতের ধান চাষে। ফলে মাঠে দেশীয় জাতের ধানের জায়গা দখল কওে নিচ্চে নানা হাইব্রিড প্রজাতি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকারও এখন হাইব্রিড ধান চাষে উৎসাহ দিচ্ছে।

একসময় এ উপজেলার কৃষকেরা বিভিন্ন দেশীয় জাতের ধান চাষ করতেন। প্রাকৃতিক জৈবসারনির্ভর সেই চাষে খরচ ছিল তুলনামূলক কম। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদিত সেই ধানের স্বাদ, ঘ্রাণ ও পুষ্টিগুণ ছিল অনন্য। বর্তমানে আউশ, আমন ও বোরো সব মৌসুমেই কৃষকেরা সরকার অনুমোদিত ও বহুজাতিক কোম্পানির নতুন নতুন নামের বীজের ওপর নির্ভরশীল। ফলে দেশীয় জাতের ধানের আবাদ দিন দিন কমে যাচ্ছে।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাটিরাঙ্গায় ৫ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ করা হয়, যার সম্ভাব্য উৎপাদন ৪ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫ হাজার ৪৬ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সম্ভাব্য উৎপাদন ৪ হাজার ৭৬০ মেট্রিক টন । এ উপজেলায় বর্তমানে সর্বমোট ২৪ জাতের হাইব্রিড ধান চাষ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় ব্রি-ধান ৪৯ জাতের। দেশীয় জাতের মধ্যে বিন্নি, কালোজিরা ও ঘিয়জ এখনো কিছু কৃষকের জমিতে টিকে আছে। মাটিরাঙ্গার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকেরা এখন প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করছেন। দেশীয় জাতের ধান চাষ করছেন হাতে গোনা কয়েকজন কৃষক। তাদের মতে, বাজারে দেশীয় ধানের দাম কম, ফলনও তুলনামূলকভাবে কম, অথচ হাইব্রিডে ফলন প্রায় দ্বিগুণ।

কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, কাটারিভোগ, নাজিরশাইলের মতো দেশীয় জাতের ধান শুধু স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্যই নয়, পুষ্টিগুণ ও জলবায়ু উপযোগিতার জন্যও পরিচিত। এসব ধান কম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে চাষ করা যায়, যা পরিবেশের জন্য উপকারী। কিন্তু বাজারে হাইব্রিডের দাপটে এসব জাতের চাহিদা ও চাষ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।

কৃষিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় কৃষকেরা হাইব্রিডের দিকে ঝুঁকলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। স্থানীয় জাত বিলুপ্ত হলে খাদ্য নিরাপত্তা ও বীজ বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় ধান সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে ‘বীজ ব্যাংক’ গঠন ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। না হলে, অচিরেই দেশীয় জাতের ধান শুধু কৃষকের স্মৃতিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

আমতলীর কৃষক মো. আলম বলেন, “দেশীয় জাতের ধান চাষ করতে কোনো বীজ বাজার থেকে কিনতে হতো না। বীজের জন্য কিছু ধান আলাদা করে ঘরে তুলে রাখলেই চলতো। এখনকার হাইব্রিড ধান থেকে বীজ রাখা যায় না। প্রতি বছর বাজার থেকে চড়া দামে বীজ কিনতে হয়। পাশাপাশি কীটনাশক, সার ও সেচের খরচও বেড়েছে।”

কৃষক আবুল কালাম বলেন, “হাইব্রিড ধান চাষের মূল কারণ ফলন বেশি হয়। দেশীয় ধানে পোকামাকড় কম হলেও ফলন কম, তাই বাধ্য হয়ে হাইব্রিড চাষ করি।”

কৃষক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, “দেশীয় ধান লাগাতে মন চায়, কিন্তু লাভ হয় না। হাইব্রিডে ফলন বেশি, তাই সেটাই করি।”

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. সেলিম রানা বলেন, “আমরা কৃষকদের দেশীয় জাত সংরক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছি। হাইব্রিড জাতের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী দেশীয় ধান রক্ষা করা গেলে ভবিষ্যতের জন্য তা বড় সম্পদ হয়ে থাকবে।”

মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সবুজ আলী বলেন, দেশীয় বীজ যাতে একেবারে হারিয়ে না যায়, সেজন্য কৃষি অফিস বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন এবং কৃষকদেরও উচ্চ ফলনশীল বীজের পাশাপাশি দেশীয় বীজ সংরক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছেন।


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.