ছবি: সংগৃহীত
রংপুরে এক মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী ও তার কর্মচারীদের সাজানো নাটকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাকিবুজ্জামান রাব্বি (৩০) নামে এক নিরাপরাধ যুবকের জীবন। একের পর এক মিথ্যা ও সাজানো মামলায় এখন তার অধিকাংশ সময় কাটছে আদালতের বারান্দায়। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন জামান।
অভিযোগে জানা যায়, রাকিবুজ্জামান রাব্বির বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। তিনি জামান নামে পরিচিত। ২০০৮ সাল থেকে রংপুর নগরীর সিগারেট কোম্পানি এলাকায় তার মামার বাড়িতে থাকতেন।
রংপুর শহরের মোবাইল ফোনের ডিলার এসটিআর মোবাইল গ্যালারিতে (এল ডি হাউস) ২০১৭ সালে যোগদান করেন জামান। ২০১৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের হয়ে গাইবান্ধায় এবং ২০২১ সাল থেকে পুনরায় রংপুরে চাকরি করতে থাকেন। প্রায় এক বছর কোনো পদ না থাকা অবস্থায় কাজ করার পর ২০২২ সালে সফটওয়্যার ম্যানেজার পদে পদোন্নতি হয় তার। সেই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই পদে কাজ করেন জামান। প্রতিষ্ঠানটি রিয়ালমি, ইনফিনিক্স ও ওয়ানপ্লাস ফোনের ডিলার। এসটিআর ও এলডি হাউস দুটো আলাদা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের দৈনন্দিন হিসাব কার্যক্রম আলাদা।
সফটওয়্যার ম্যানেজার হিসেবে জামানের কাজ ছিল শুধু কোম্পানি থেকে আসা মোবাইল ফোনের আইএমইআই সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করা এবং বিক্রি হলে তা কোন দোকানে গেছে এবং সারাদিন কতগুলো আইএমইআই অফিস থেকে গেছ তার হিসাব রাখা। দিন শেষে সেই রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে পাঠিয়ে দিতেন।
প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন ও যাবতীয় টাকার হিসাব সংরক্ষণের কাজ ছিল সহকারী ম্যানেজার ও ক্যাশিয়ার জাকারিয়া রায়হান জয় এবং প্রধান ম্যানেজার আব্দুর রহমানের। প্রতি মাসে অডিট করা এবং যাবতীয় আয়-ব্যয়ের বিবরণী প্রতিষ্ঠানের মালিক ও মালিকের চাচাতো ভাই রাসিফের কাছে বুঝিয়ে দিতেন আব্দুর রহমান।
চাকরি করাকালীন সময় মামা, বাবা, স্ত্রী ও শশুরের সহযোগিতায় ২০২১ সালে জামান এন্টারপ্রাইজ নামে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের ডিলারশিপ নিয়ে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন জামান। নিজ ব্যবসার প্রয়োজনে ২০২৩ সালে এলডি হাউসের ম্যানেজার সিফাত হোসেনের কথা মতো ব্রাক ব্যাংকে একটি হিসাব নম্বর চালু করেন জামান এবং দুই দফায় ২০ ও ৩২ লাখ টাকাসহ মোট ৫২ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে লোন নেন।
দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে ভালো সম্পর্ক ও বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠায় তার চেক বই ও হিসাব নম্বর ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করতেন এলডি হাউসের সহকারী ম্যানেজার ও ক্যাশিয়ার জাকারিয়া রায়হান জয় এবং মাঝেমধ্যে জামানের কাজ থেকে ১ থেকে ৫/ ৭ লাখ পর্যন্ত টাকাও ধার নিতেন এসটিআর মোবাইল গ্যালারির প্রধান ম্যানেজার আব্দুর রহমান এবং সহকারী ম্যানেজার ও ক্যাশিয়ার জাকারিয়া রায়হান জয়। জামানের চেক বই তার অফিসের ব্যক্তিগত ড্রয়ারে থাকতো এবং সেই ড্রয়ারের ডুপ্লিকেট চাবি যে জাকারিয়া রায়হান জয়ের কাছেও থাকতো সেটা জামান আগে থেকে জানতেন না। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের এক বিক্রয় প্রতিনিধির কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে জামানের মামার সঙ্গে আব্দুর রহমানের পারিবারিক বিরোধের জেরে। এতে আব্দুর রহমান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং জামানকে শায়েস্তা করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এদিকে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রধান ম্যানেজার আব্দুর রহমানের কাছে বিগত ৩/৪ বছরের হিসাব দাখিলের নির্দেশ দেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
ওইসময় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন জামান। একপর্যায়ে তাকে নিয়ে কবিরাজের কাছে যান সিফাত। এরপর কবিরাজের ওষুধ খেয়ে আরো শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন জামান। ধীরে ধীরে তার স্মৃতিভ্রম ঘটতে থাকে। এসময় তার অফিসিয়াল কাজ সিফাত ও জাকারিয়া রায়হান জয়সহ অন্য স্টাফরা করে দিতেন।
বেশ কিছুদিন এ অবস্থা চলার পর ধীরে ধীরে জামান সুস্থ হয়ে উঠলে এলডি হাউসকে বিভিন্ন সময়ে ধার দেয়া প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকা ফেরত চান জামান। কিন্তু আব্দুর রহমান ও জাকারিয়া রায়হান জয় আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে বলেন যে, তোমাকে তো টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এদিকে দুর্নীতির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে জামানের অনুপস্থিতর সুযোগে সফটওয়্যার কারসাজির মাধ্যমে আব্দুর রহমান ও জাকারিয়া রায়হান জয় কৌশলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ২০ লাখ টাকার ঘাটতি তৈরি করেন। শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হবার পর জামান অফিসে গিয়ে হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানে ২০ লাখ টাকার মতো গড়মিল। পরে বিষয়টি জয় ও রহমানকে জানালে তারা কৌশলে এড়িয়ে যান। এসময় জামান দৈনন্দিন ক্যাশ রেজিস্ট্রার চেক করতে চাইলে তা দিয়ে রাজি হননি জয় ও রহমান।
একপর্যায়ে ধারের ৩০ লক্ষাধিক টাকা ফেরত দেয়া তো দূরের কথা উল্টো ঘাটতির ২০ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য প্রতিনিয়ত জামানকে চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকেন জয় ও রহমান। বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার দেখা পাননি জামান। উপায় না পেয়ে প্রাণভয়ে ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরের পর অফিস যাওয়া থেকে বিরত থাকেন জামান।
দুই মাস পর রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার এসআই শাহানুর হোসাইন সরকার সঙ্গীয় ফোর্সসহ তাকে ঢাকা থেকে আটক করেন। পরে রংপুরে নিয়ে আসার সময় রাস্তায় তাকে ক্রসফায়ারসহ পরিবারের সদস্যদের মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে টাকা আত্মসাতের দায় স্বীকারের হুমকি দেন শাহানুর। পরে পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দিয়ে আদালতে হাজির করা হলে বাধ্য হয়ে দোষ স্বীকার করে নেন এবং আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ১৪ দিন কারাভোগের পর চার্জশিট দাখিল করা পর্যন্ত জামিনে বেরিয়ে এসে জানতে পারেন যে, জামান ও তার মামা ইসমাইল হোসেন এবং মামাতো ভাই ফিরোজের নামে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতসহ চেক প্রতারণার চারটি মামলা ও একটি জিডি করা হয়েছে।
এ অবস্থায় কমবেশি টাকা পরিশোধের মাধ্যমে আপোষ মীমাংসার চাপ দিতে থাকেন বাদীর এক আইনজীবীসহ অন্যরা। পরিবারের অন্য সদস্যদের বিভিন্নভাবে ফাঁসানোর হুমকিও দিতে থাকেন তারা।
পরে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন গত ১৪ মে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এসময় জামান জানতে পারেন যে, মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। দুই মাস কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান জামান।
জামান জানান, চাকরিতে যোগদানের পর ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী চেকের ফাঁকা পাতা জামানত হিসেবে জমা রাখতে হয়। সে কারণে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি চেকের ফাঁকা পাতায় শুধু স্বাক্ষর দিয়ে জামানত হিসেবে জমা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে ওই চেকবই হারিয়ে গেলে ২০২২ সালে থানায় জিডি করেন এবং জিডির কপি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দিয়ে নতুন চেকবই সংগ্রহ করেন। সেই থেকে নতুন স্বাক্ষর ও নতুন চেকের মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করতেন।
জামানের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরের পর অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিলে এর কয়েকদিন পর ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি সেই জামানত হিসেবে রাখা চেকের পাতায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বসিয়ে ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সেই চেকবইয়ের স্বাক্ষরের সঙ্গে নতুন চেকবইয়ের স্বাক্ষর না মিললে ব্যাংক থেকে তা বাতিল করা হয়।
এছাড়া জাকারিয়া রায়হান জয়ের শ্বশুর এনামুল হকের নামে ৬২ লাখ টাকার চেক জমা দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়। অথচ জয়ের শ্বশুর এনামুল হকের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয়নি এবং ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কোনো লেনদেনও ছিল না। জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৬২ লাখ টাকা পাওনা দেখিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জামানের অভিযোগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বিক্রি হতো। প্রতিদিনের বিক্রি পরের দিন কোম্পানির ব্যাংক হিসাব নম্বরে পাঠানো হতো। এছাড়া দোকানে কতগুলো ফোন স্টক আছে তা সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোম্পানিসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সবসময় আপডেট থাকতেন। অথচ ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর শেষ অফিসের দিন ২০ লাখ টাকার ১৪০ সেট মোবাইল ফোন, ৯০ লাখ টাকা নগদ ও ১৫ লাখ টাকা কর্মচারীদের বেতন আত্মসাত দেখিয়ে মোট ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন পরিচালক শফিকুল ইসলাম। অথচ ১১ জন স্টাফের বেতন সর্বসাকুল্যে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যা অফিসে রাখা বেতন শিটে উল্লেখ করা হতো।
জামান আরও বলেন, আব্দুর রহমান ও জাকারিয়া রায়হান জয় নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। পরিচালক শফিকুল ইসলামকে ভুল তথ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে। মামলার ঘানি টানতে গিয়ে এখন প্রতিনিয়ত তাকে আদালতে ঘুরতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জামান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় এসটিআর মোবাইল গ্যালারির (এলডি হাউস) প্রধান ম্যানেজার আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজন স্টাফ রয়েছে। তাদের মধ্যে তিনিসহ রাসিফ, সিফাত ও জয় সবকিছু দেখভাল করেন। তার কাছে অন্য মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এক কোটি ৩০ লক্ষ টাকার মামলা, আর অন্য মামলা আমাদের না। অন্য মামলাগুলো আপনাদের স্টাফ করেছে।
নিজের দুটি বাড়ি জায়গা-জমি ও অর্থ প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান বলেন, আমি দীর্ঘ প্রায় ২৩-২৪ বছর ধরে চাকরি করছি। গ্রামের তো ২-৪ শতক জমি, তেমন কিছু নেই। আর আমার কাছে এসবের প্রমাণ আছে। ম্যানেজার আব্দুর রহমানের কাছে তার ডিলার হাউজের প্রতিদিন কত টাকা বিক্রয় হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনেক টাকা বিক্রি, কোন দিন ১৫ লক্ষ, ১৬ লক্ষ বা ২০ লক্ষ টাকা। এই বিক্রয়কৃত টাকা কোম্পানিকে১-২ দিন পরে ব্যাংকের মাধ্যমে টিটি করতে হয়, মাঝে মাঝে ১ সপ্তাহের মধ্যে টিটি করতে হয়।
বিক্রয়কৃত টাকা ১-২ দিন পরে টিটি করতে হয় তাহলে আপনার অফিসে কিভাবে ১ কোটি টাকার উপরে থাকে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে সে (জামান) প্রায় ১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মর্মে কোর্টে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। জামানের কাছে কেন টাকা থাকে, জানতে চাইলে ম্যানেজার আব্দুর রহমান বলেন, জামান হচ্ছে মূল ম্যানেজার। আমাদের ওয়্যার হাউজের সমস্ত দায়িত্বই তার।
প্রতিষ্ঠানে ক্যাশিয়ার থাকা সত্ত্বেও তার কাছে টাকা কেন থাকে জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, সে তো ম্যানেজার বস, তার কাছেই লকারের চাবি থাকে। নভেম্বর মাস পর্যন্ত আপনাদের এলডি হাউজের সমস্ত টাকা পয়সা ও স্টক ক্লিয়ার ছিল, কোন সমস্যা ছিল না শুধু ডিসেম্বর মাসেই ঝামেলা এটা আপনার কথা, তো এই অল্প সময়ে কিভাবে এত টাকা নিতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ক্লোজিংয়ের সময় অনেক টাকা থাকে। মামলা বিচারাধীন আছে, সেখানে প্রমাণ হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh