দিনমজুরের ঘরে জন্ম আমিনুল ইসলামের (৩৫)। বৃদ্ধ মা-বাবা সহ ছয় সদস্যের পরিবার। আমিনুলের বাবার একার উপার্জনেই কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতো গোটা পরিবারের। আমিনুলের বাবা বয়সের ভারে কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় চরম বিপাকে পরতে হয় গোটা পরিবারকে। এমন পরিস্থিতিতে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও বৃদ্ধ বাবা-মা ও স্ত্রী সন্তানের দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন আমিনুল। প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদের মতো ভিক্ষাবৃত্তি করেন না তিনি। নিজের বাড়ির পাশের বাজারে দিয়েছেন সেলুন দোকান। বাঁকা মেরুদন্ডের (কুঁজে) আমিনুল সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননা তবুও কাঁধে বইছেন সংসারের বোঝা। তার উপার্জনেই স্বচ্ছলতা ফিরেছে পরিবারে। আমিনুল ইসলামের বাড়ী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের চর বড়লই গ্রামে। তিনি ওই এলাকার ইছব আলীর ছেলে।
জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও কাজে বেশ দক্ষ আমিনুল। তার কাজের এমন দক্ষতায় এলাকায় সবাই তাকে মেসি নামেই ডাকে। উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের বাংলাবাজারে নিজের সেলুনে চুল-দাড়ি কাটার কাজ করে ব্যস্ত সময় কাটে তার। কাজের মান ভালো হওয়ায় এবং দাম কম রাখায় দূর দূরান্ত থেকে তার সেলুনে চুল-দাড়ি কাটতে ভিড় করেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
ওই এলাকার রানা মিয়া (২৯) জানান, মেসি ভাইয়ের ব্যবহার ও কাজের মানও অনেক ভালো। তাই এখানেই চুল -দাড়ি কাটানোর কাজ করে নিতে আসি। তিনি এত নিখুঁত ভাবে চুল-দাড়ি কাটার কাজ করেন। বোঝার উপায় থাকে না যে তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী।
সেলুনে চুল-দাড়ি কাটাতে আসা আশরাফুল (৩০) জানান, মেসি ভাই নিখুঁতভাবে চুল দাড়ি কাটতে পারে। দামও কম নেয়। চুল -দাড়ি কেটে নিয়ে ৪০-৫০ টাকা দিলেই মেসি ভাই তাতেই খুশি। কাজের মান হওয়ায় সবসময় মেসির কাছেই চুল-দাড়ি কাটাতে আসি। তবে এখানে আসলে সময় একটু বেশি লাগে কেননা তার সেলুনে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে।
আমিনুল ইসলাম জানান, আমি জন্মগতভাবেই কুঁজে। মেরুদন্ড বাঁকা হওয়ার কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারিনা। শারীরিক ভাবে কাজে অক্ষম হওয়ায় কেউ কাজে ডাকতো না। এদিকে বাবাও কাজ করতে অক্ষম। অভাবের সংসারে কি কষ্টে দিন কেটেছে বলে বুঝাতে পারবো না। আমার প্রতিবন্ধী ভাতার সামান্য কিছু টাকা পেতাম। তাতে কি আর সংসার চলে? সকালে খাবার খেতে পারলে রাতে খাবার জুটতো না। কাপড়ের খুব অভাব ছিল। ঠান্ডায় পোশাকের অভাবে কি যে কষ্ট হতো। কতদিন যে বৃদ্ধ বাবা-মা ও আদরের ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে অনাহারে থেকেছি। জানেন, তবুও কারো কাছে হাত পাতিনি। কেন জানি ছোটবেলা থেকেই ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি আমার মনের ভিতর একটা ঘৃণা কাজ করত।
যাহোক পরিবারের হাল ধরতে সেলুনের দোকান খুলি। মুসলিম হওয়ায় প্রথম প্রথম অনেকেই এ কাজের সমালোচনা করে। পরবর্তীতে কাজের মান ভালো হওয়ায় অনেকেই চুল-দাড়ি কাটতে আমার সেলুনে আসেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি, প্রতিদিনেই ৬০০-৭০০ টাকা ইনকাম হয়, কখনো এর থেকেও কম-বেশিও হয়, তবে যা আয় রোজগার হয় তাই দিয়ে এখন পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে আছি। সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।
আমিনুল ইসলাম শুধু পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে থেমে থাকেননি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করছেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম এর আয়োজনে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে মন রঙের পাঠশালার সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন থেকে।
অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা অন্তু চোধুরী বলেন, মেসি ভাইকে আমরা কখনোই শারীরিক প্রতিবন্ধী মনে করিনা। নানান প্রতিকূলের মাঝে তিনি আমাদের যেকোন ইভেন্টে সকলের আগেই চলে আসে এবং তার যে দায়িত্ব গুলো থাকতো তিনি সব কিছুই এত গোছানো ভাবে করতেন যা আমাদের অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের শিখতে সাহায্য করেছে। তিনি আমাদের মন রঙের পাঠশালার জন্যে একজন নিবেদিত প্রাণ। বাচ্চাদের সাথে মিলেমিশে কাজ করে বাচ্চাদের জন্য এবং আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য তিনি একজন আদর্শ স্বেচ্ছাসেবক। তিনি আমাদের মন রঙের পাঠশালাকে আরো বেশি আলোকিত করেছেন।
আমিনুল ইসলামের ব্যাপারে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা ওয়ালীউল্লাহ মন্ডল বলেন, আমিনুল ইসলাম প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় রয়েছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও নিজের উপার্জনে সংসারের হাল ধরেছে এটা শুনে ভালো লাগলো। পরবর্তীতে কোন সরকারি সুযোগ সুবিধা আসলে তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তার প্রতি শুভকামনা রইল।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
