× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

জ্ঞানের বাতিঘর আদর্শ শিক্ষক সুজিত সাহার অবসর

ছাইদুর রহমান নাঈম, কটিয়াদী ( কিশোরগঞ্জ)

০১ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৪৭ এএম

বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ তেমনি শিক্ষকতা এমন এক পেশা, যার হাত ধরে গড়ে উঠে একেকটা আদর্শ সন্তান, দেশ ও মানবজাতির জন্য একেকটা আলোকবর্তিকা। সকলেই শিক্ষক, তবে এর মধ্যে এমন কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যার চিন্তা, সাধনা ও পেশাকে নেশার মধ্যে নিয়ে এসে শিক্ষা প্রচারকে জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

এমনি একজন আদর্শ শিক্ষক হলেন সুজিত কুমার সাহা। তিনি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পৌর এলাকার পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রয়াত হরেন্দ্র কুমার সাহার তিন ছেলে ও প্রয়াত এক মেয়ের মধ্যে সুজিত সবার ছোট। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছরের চাকরি জীবন শেষে অবসরে গিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ এই স্কুলেই টানা ১৯ বছর ছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) ছিল তার শেষ কর্মদিবস। এর আগে স্কুল মাঠে বিদায়ী এক অনুষ্ঠানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লে এক আবেগঘন ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এই সময়ে উপস্থিত অতিথি, শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও উপস্থিত এলাকাবাসী-সবার চোখ ছিল অশ্রুভেজা।

সুজিত সাহা এমনি একজন মানুষ, দীর্ঘ জীবনে বিনাবেতনে পড়িয়েছেন শিক্ষার্থীদের। ক্লাস ছাড়া আলাদা সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসা ও স্কুলে মিলিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিজের খাটুনি দিয়ে পড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কখনও তিনি টাকা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেননি। সাদামাটা জীবনযাপন করা এই মানুষটি নিয়মিত বাইসাইকেলে স্কুলে আসেন। এটাই তার দীর্ঘদিনের সাথী হয়ে আছে। একাধিকবার তিনি উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।

যিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াকে ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়েছেন। স্কুলকে বাড়ি এবং শিক্ষার্থীদের নিজ সন্তান হিসেবে দেখতেন। পাঠদানের সঙ্গে তিনি মিশে গিয়েছেন নিজের হৃদয় দিয়ে। তার শ্রেণিকক্ষ ছিল জ্ঞানের বাতিঘর। আর তার জীবন ছিল এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত - কেমন করে একজন মানুষ নিজেকে সমাজের কল্যাণে উৎসর্গ করতে পারে। অবহেলিত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পরম যত্ন করে পাঠদান করিয়ে ভালো ফলাফল অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে।

ফলে অল্পদিনেই স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সবখানেই। প্রাথমিক স্কুলে যেখানে কমছে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, সেখানে ঠিক উল্টো চিত্র। প্রতিবছর ভর্তির জন্য বরং অপেক্ষায় থাকতে হয় অভিভাবকদের। এই সময়ে তিনি তৈরি করেছেন অজস্র শিক্ষার্থী, যারা আজকে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কাজ করছে। এছাড়াও তিনি ছিলেন প্রকৃত মানুষ তৈরির কারিগর।

এলাকাবাসী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি সময়ের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। স্কুলের সময়ের আগেই তিনি সবসময়ই উপস্থিত হতেন এবং সবার পরে স্কুল ত্যাগ করতেন। অভিভাবকদের নিকট তিনি এক ভরসার প্রতীক। স্কুলে ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মতো আদর করে কঠিন বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। কঠোর শাসন ছাড়াও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে পাঠদানে মনোযোগী করার অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত তার মধ্যে দেখা যায়। স্কুলের সময় শেষ হলেও তিনি বাড়ি যান অনেক পরে। কারণ হচ্ছে, এর মধ্যে সাবেক কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা করার জন্য তার মনেপ্রাণে টান থাকতো। এই সময়ে অনেকেই এসে তাদের প্রিয় শিক্ষকের খোঁজখবর নিতে আসে।

শিক্ষক সুজিত কুমার সাহার শিক্ষা জীবন ছিল নানান অভাবে ভরা, কিন্তু সেই সংগ্রামই তাকে গড়ে তুলেছে এক আলোকিত মানুষে, যিনি আজ অসংখ্য শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা। শৈশব থেকেই ছিলেন পরিশ্রমী, বিনয়ী ও দৃঢ়চেতা। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সুজিত ছিলেন সবার ছোট। শুরুর সময়টা খুব সুখকর ছিল না। পারিবারিক কষ্ট, আর্থিক অনটন আর জীবনের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তিনি কখনো হার মানেননি। অনেক সময় হয়তো টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বই কিনেছেন, কখনও রাতভর প্রদীপের আলোয় পড়েছেন। এই স্কুলেই তার শৈশবের পড়াশোনার হাতেখড়ি। ১৯৯০ সালে শিক্ষকতার শুরু হয় হাইস্কুলে। প্রায় আট বছর সেখান থেকে পরে স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে ছিলেন আট বছর। সর্বশেষ কটিয়াদী ১নং স্কুলে টানা ১৯ বছর তিনি শিক্ষক হিসেবে ৩৫ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে চাকরি জীবনের ইতি টেনেছেন। সুজিত সাহা সাংসারিক জীবনে চিরকুমার রয়েছেন।

কটিয়াদী ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক প্রধান শিক্ষক সুজিত কুমার সাহা বলেন, কাগজ-কলমে বিদায় হলেও একজন শিক্ষকের কোনো স্থায়ী বিদায় হয় না। স্কুল ও শিক্ষার্থীরাই আমার প্রাণ। কখনও হয়তো শিক্ষার্থীদের সাথেই আমার মৃত্যু হবে এবং তারাই আমাকে কাঁধে নিয়ে জীবনের শেষ যাত্রা করবে। পিতামাতার পরে শিক্ষক অভিভাবক, আমি এটাকেই শুধু দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। কতটুকু পেরেছি তা নির্ণয়ের দায়িত্ব আপনাদের হাতে। আমি সাবেক ছাত্রদের জন্য স্কুল ছুটির পরেও অপেক্ষা করে বসে থাকি, যদি কেউ আমাকে দেখতে আসে তার জন্য। আমার জীবনকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে উৎসর্গ করেছি।

কটিয়াদী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, শিক্ষক সুজিত কুমার সাহা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিরল একজন মানুষ। প্রাথমিক শিক্ষার জাগরণে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কঠোর শাসন ছাড়াও কিভাবে ছাত্রদের পাঠদানে আগ্রহী করে তোলা যায়, এটা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় মডেল।


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.