ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান
নিঃশব্দতার এক নিবিড় ক্যানভাসে আঁকা রফিক আর শিউলির জীবন, যেখানে শব্দ নয়, চোখ কথা বলে। কিন্তু যেদিন শিউলি ইশারায় রফিককে জানালেন, তাদের জীবনে আসছে এক নতুন অতিথি, সেদিন সেই নীরব ক্যানভাসে আনন্দের রং ছিটিয়েও এক গভীর ধূসরতা নেমে এলো। কারণ তারা দু'জনেই জানেন, এই পৃথিবীর কঠিনতম বাস্তবের সামনে এবার দাঁড়াতে হবে তাদের সন্তানকে নিয়ে। এই ভয়টা কোনো বিচ্ছিন্ন ভাবনা নয়—সন্তান জন্মের সুখবর পাওয়ার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ। আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীরা যখন নিজেদের মধ্যে মুখ টিপে হাসে বা ফিসফিস করে, রফিক-শিউলি তাদের ঠোঁট নড়া দেখেই বুঝতে পারেন সেই সমালোচনা, যা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত করে, আর সেটাই তাদের প্রথম সামাজিক সমালোচনা ও ফিসফিসানি শিকার করে তোলে।
গর্ভকালীন পুরোটা সময় জুড়েই চলতে থাকে এক মানসিক ঝড়। তারা ভাবেন, শিশুর কান্না, ক্ষুধা বা কষ্টের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেলে তারা তা ঠিকভাবে বুঝতে পারবেন তো? তাদের নীরব ঘরে, প্রকৃতির নিয়মে যখন শিশুটির ভাষা বিকাশের সময় আসে, তখন সেই শিশুটি পায় না তার বাবা-মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত কোনো শব্দ, যা তৈরি করে প্রাথমিক ভাষা মডেলের অনুপস্থিতি। দু'জনের নিস্তব্ধতা যেন সন্তানের ভাষা শেখার পথে এক বিশাল পাহাড়ের মতো দাঁড়ায়। যখন দুই বছর পেরিয়েও শিশুটি স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না, তখন বিলম্বিত বা অস্বাভাবিক বাচনভঙ্গি দেখে তাদের বুকটা কেঁপে ওঠে, আর সেই মুহূর্তে বাবা-মায়ের হতাশা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তারা বুঝতে পারেন, কথা শেখানোর জন্য তাদের সমাজের ওপর, বিশেষ করে দাদা-দাদি বা নানা-নানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে, যা তাদের আত্মবিশ্বাসে আরও চিড় ধরায়।
আসলে, রফিক-শিউলি’র মতো হাজারো দম্পতির জীবন এই প্রতিকূলতাগুলোর মধ্য দিয়েই এগোয়। তাদের সন্তানের জন্য যখন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট (SLT) খোঁজ করার প্রয়োজন হয়, তখন দেখা যায় বাংলাদেশের ছোট শহরগুলোতে বিশেষজ্ঞের অপ্রতুলতা। যদি বা পাওয়া যায়, তখন শুরু হয় চিকিৎসার অর্থনৈতিক বোঝা, যা তাদের সীমিত আয়ের ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের কথা শেখার প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখন বাবা-মা আর সন্তানের মধ্যে মাঝে মাঝেই যোগাযোগের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়, যা পরিবারে ছোটখাটো মনোমালিন্যের জন্ম দেয়। এই সব প্রতিকূলতার কারণে দম্পতি ধীরে ধীরে নিজেদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (Isolation) তৈরি করে, কারণ তারা মনে করেন, বাইরে গেলে তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। এই নীরব সংগ্রাম তাদের দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
শিশুটি যখন একটু বড় হয় এবং স্কুলে যেতে শুরু করে, তখন শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের কঠিন পরীক্ষা। স্কুলে ভর্তি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ তো আছেই, তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো শিক্ষকের সাথে যোগাযোগের বাধা। সামান্য কোনো সমস্যা বা সন্তানের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করতেও রফিক বা শিউলিকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। আর স্কুলের মাঠে যখন অন্য শিশুরা বাবা-মায়ের অক্ষমতার জন্য তাদের সন্তানকে ঠাট্টা/বিদ্রূপ করে, তখন শিশুটির মনে বিব্রতবোধ তৈরি হয় এবং তার আত্ম-মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। এর ফলস্বরূপ, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে প্রায়শই বাবা-মায়ের জন্য 'অনুবাদক' বা দোভাষীর ভূমিকা নিতে হয়, যা তার স্বাভাবিক শৈশবের উপর এক অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করে। আর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, এই দম্পতিরা প্রায়শই আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতায় ভোগেন—ব্যাঙ্কে সই করা থেকে সরকারি দপ্তরে দরখাস্ত করা পর্যন্ত সবখানেই অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়।
বাংলাদেশে বাক প্রতিবন্ধী দম্পতির সন্তানের ভাষা বিকাশের সংগ্রাম কতটা গুরুতর, তা বোঝার জন্য একটি ধারাবাহিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা আবশ্যক। এই পরিসংখ্যানটি সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলোর তথ্য ও ২০৪০ সাল পর্যন্ত একটি বাস্তবসম্মত প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে:

উপরের পরিসংখ্যানটি এক চরম বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরে—২০২৫ সাল নাগাদও এই শিশুরা মাত্র ২২% স্পিচ থেরাপি অ্যাক্সেস পাচ্ছে, যেখানে একটি শিশুর দ্রুত ভাষা বিকাশের জন্য ১০০% অ্যাক্সেস প্রয়োজন। ২০৪০ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণটি আশার আলো দেখালেও, এই দীর্ঘ সময়ে হাজারো শিশু শিক্ষামূলক চ্যালেঞ্জ এবং ব্যক্তিগত বিকাশে প্রভাব এর শিকার হবে।
এই কঠিন প্রতিকূলতার মুখে রফিক-শিউলি’র মতো দম্পতিরা কিন্তু তাদের নীরব ভালোবাসার জোরে জয়ী হতে পারেন। এই মুক্তি আসে সাতটি উজ্জ্বল পথের মাধ্যমে:
প্রথমত, নিয়মিত বিশেষজ্ঞ স্পিচ থেরাপিস্টের সাথে নিবিড় সহযোগিতা নিশ্চিত করা, যা সন্তানের ভাষা বিকাশের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, পরিবারের স্বাভাবিক ভাষাভাষী সদস্যদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা, যাতে শিশুটি খেলার ছলে, ভালোবাসার স্পর্শে ভাষা শুনতে পায় ও শিখতে পারে। তৃতীয়ত, দ্বিভাষিক শিক্ষার কৌশল অবলম্বন করা—বাবা-মা ইশারা ভাষার পাশাপাশি ফ্ল্যাশকার্ড বা চিত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মুখে শব্দ তৈরির ধারণা দিতে পারেন। চতুর্থত, 'CODA' সাপোর্ট গ্রুপে অংশগ্রহণ করা, যেখানে সন্তান তার মতো পরিস্থিতিতে থাকা অন্য শিশুদের সাথে মিশে নিজের ভেতরের দ্বিধা দূর করতে পারে। পঞ্চমত, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন ভয়েস জেনারেটিং ডিভাইস বা অ্যাপস ব্যবহার করে বাবা-মা তাদের দৈনন্দিন যোগাযোগ সহজ করতে পারেন। ষষ্ঠত, অল্প বয়স থেকেই প্লে-স্কুল বা ডে-কেয়ারে ভর্তি করে দিয়ে সন্তানের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করা, যা তাকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার সুযোগ করে দেবে। এবং সবশেষে, সরকারি উপবৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর চেষ্টা করা, যাতে চিকিৎসার খরচ নিয়ে তাদের আর দুশ্চিন্তা করতে না হয়। এই পথগুলো কেবল পরিত্রাণের উপায় নয়, এগুলো সন্তানের মুখে প্রথম ডাক শোনার জন্য নীরব বাবা-মায়ের ভালোবাসার অঙ্গীকার। "যে হৃদয়ে ভাষা নেই, সে হৃদয় সন্তানের ভাষা ফোটাতে আকাশ কাঁপানো সংকল্প রাখে! আমাদের নীরবতা আমাদের দুর্বলতা নয়, আমাদের ভালোবাসার গভীরতা; আমাদের সন্তানের কন্ঠস্বর হবে আমাদের বিদ্রোহের ভাষা, যা সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপড়ে ফেলবে এবং সমাজের চোখে চোখ রেখে বলবে—আমরাও পারি!"
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।
দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে একজন নিয়মিত মাস্টার্স স্টুডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রজেক্ট এনালিস্ট হিসেবে ইউএনডিপি বাংলাদেশে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি আইডিএলসি ফাইনান্স পি এল সি-তে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত আছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
