রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থেকে যাত্রা শুরু করলে পাহাড় যেন একেকটা জীবন্ত দৃশ্যপট হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সকালবেলায় কুয়াশায় ঢেকে থাকে চারদিক, সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে। বাতাসে ভাসে ভেজা পাতার গন্ধ, দূরে কোথাও মোরগের ডাক, আর পাশে কোনো পাহাড়ি কিশোরী কাঁধে বাঁশের ডালি নিয়ে হেঁটে চলে পানির উৎসের দিকে। প্রথম দেখায় এ এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য মনে হলেও, এই সৌন্দর্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক নির্মম বাস্তবতা! পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা, যা প্রতিদিনের সংগ্রাম, ঘাম আর প্রতীক্ষায় গড়া।
পাহাড়ের সকাল শুরু হয় শহরের চেয়ে অনেক আগে। ভোর না হতেই মানুষ ঘুম থেকে উঠে যায়। কেউ হাঁস-মুরগি সামলায়, কেউ জুমের পাহাড়ে ওঠে, কেউবা নদীর ধারে যায় পানি আনতে। এখানে সময়ের হিসাব সূর্যের আলোয় মাপে, ঘড়িতে নয়। পাহাড়ের ঢালে বসবাস করা মানুষগুলো সূর্যের সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে, আর সূর্য ঢলে পড়লে ঘরে ফেরে। আলো শেষ হলে জীবনও থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
পাহাড়ের প্রতিটি গ্রাম যেন প্রকৃতির আঁচলে লুকানো এক এক টুকরো পৃথিবী। ছোট ছোট টিন বা বাঁশের ঘর, আশপাশে কলাগাছ, তুলা, মরিচ আর শাকসবজির চাষ। গাছের পাতায় শিশির জমে থাকে সকালভর। দূর থেকে দেখা যায় ছোট ছোট শিশুরা স্কুলের পোশাক পরে পা ভেজাতে ভেজাতে হেঁটে যাচ্ছে কাঁচা রাস্তায়। স্কুল মানে এখানে একতলা বাঁশের ঘর, মেঝেতে ছাতা বিছিয়ে পড়াশোনা। অনেক সময় শিক্ষক আসে, অনেক সময় আসে না। তবু শিশুরা আসে, কারণ তারা জানে এই পাহাড় থেকে বেরোতে হলে শিক্ষা দরকার।
পাহাড়ে বিদ্যুৎ এখনো সব জায়গায় পৌঁছেনি। যেখানে পৌঁছেছে, সেখানেও লোডশেডিং এমনভাবে চলে যেন রাতের অন্ধকারই স্বাভাবিক। অনেক পরিবার এখনো সৌর প্যানেলে ভরসা করে, কেউবা কেরোসিনের বাতি জ্বালায়। বৃষ্টি হলে বাতাসে কুয়াশা জমে, আলো টিমটিম করে জ্বলে, আর সেই আলোয় ঘরের ভেতর দেখা যায় এক মা আগুনে ভাত বসাচ্ছে, পাশে ছোট শিশু পড়ার বই খুলে বসে আছে। এই ছবিটাই পাহাড়ের জীবনের প্রতিদিনের প্রতিচ্ছবি।
খাবারের ব্যবস্থাও সহজ নয়। পাহাড়ের মানুষ মূলত জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জুম চাষ মানে নিজের হাতে মাটি পোড়ানো, বীজ বোনা, আর বৃষ্টির অপেক্ষা করা। আগুনে পোড়া জমি থেকে ধীরে ধীরে নতুন জীবন বেরিয়ে আসে ধান, মরিচ, হলুদ, কচু, শিম, আর শাকসবজি। এই জমিই পাহাড়ের জীবনের ভরসা। কিন্তু সেই ফসলে অনিশ্চয়তা চিরস্থায়ী। মাটি ক্লান্ত, বৃষ্টি অনিয়মিত, আর পশুর উপদ্রবও কম নয়। এক ফসলের পর বছরখানেক ওই জমি পরিত্যক্ত থাকে। তখন মানুষ নতুন পাহাড় খোঁজে, আবার নতুন চাষ শুরু হয়।
এখানকার বাজারগুলো সপ্তাহে একদিন বসে। পাহাড়ি মানুষ তখন সকাল সকাল পণ্য নিয়ে নেমে আসে হাটে। কেউ বাঁশ-বেতের ঝুড়ি বিক্রি করে, কেউ জুমের ফসল, কেউবা হস্তশিল্পের কাপড়। এসব বিক্রি করে পাওয়া টাকায় চাল, লবণ, তেল, আর প্রাথমিক ওষুধ কেনা হয়। অনেক সময় হাট থেকে ফেরা মানেই একদিনের জীবিকা শেষ।
পাহাড়ের নারী জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। তাদের হাতেই চলে সংসার, কৃষিকাজ, সন্তান লালন, পানি আনা, রান্না সব কিছু। পাহাড়ের ঢালে বা ঝরনার ধারে দেখা যায়, কাঁধে কলস বা প্লাস্টিকের ড্রাম নিয়ে নারীরা পানি তুলছে। বৃষ্টি না হলে পানি সংগ্রহই হয়ে ওঠে সবচেয়ে কঠিন কাজ। অনেকে সকালে বেরিয়ে দুপুরে ফেরা পর্যন্ত হাঁটে কেবল পানি আনার জন্য। তবু ক্লান্ত মুখে হাসি লেগে থাকে। এই হাসিই হয়তো পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য।
শিক্ষা এখানে বিলাসিতার মতো। স্কুল কম, শিক্ষক কম, রাস্তা খারাপ। অনেক সময় শিশুরা পাহাড় বেয়ে হেঁটে যায় কয়েক কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে। মেয়েরা পড়াশোনার চেয়ে সংসারের কাজে বেশি জড়িত থাকে। তবে সময় বদলাচ্ছে। এখন কিছু পরিবার মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছে, কারণ তারা বুঝেছে পাহাড়ের ভবিষ্যৎ সেই শিক্ষিত প্রজন্মের হাতেই।
স্বাস্থ্যসেবা পাহাড়ে এখনো এক অনিশ্চয়তার নাম। উপজেলা সদরের বাইরে চিকিৎসা কেন্দ্র পাওয়া দুর্লভ। কোনো শিশু অসুস্থ হলে পরিবারকে ঘন্টার পর ঘন্টা পথ পাড়ি দিতে হয়। নৌকা, মোটরসাইকেল, কখনো হেঁটে, কখনো পাহাড় বেয়ে। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা অনেক সময় জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান তৈরি করে। প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে সাধারণ অসুখও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। অনেক সময় ওষুধের দোকানই ‘চিকিৎসাকেন্দ্র’, যেখানে বিক্রেতার পরামর্শই একমাত্র ভরসা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা এই পাহাড়ি জীবনের আরেক অনন্ত যন্ত্রণা। বর্ষায় কাদা, পাহাড় ধস, রাস্তা বন্ধ সবই নিয়মিত ঘটনা। শুকনো মৌসুমে ধুলোয় ভরা পথ, বৃষ্টির সময় কাদায় ভরা। অনেক সময় বাজারে যাওয়া মানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটা। কোনো কোনো এলাকায় মোটরসাইকেলই একমাত্র বাহন, তাও নির্ভর করে রাস্তার অবস্থা আর আবহাওয়ার মর্জির ওপর।
বৃষ্টির দিনগুলো পাহাড়ে যেন অন্য এক পৃথিবী। কুয়াশা নেমে আসে গাছের মাথায়, নদীগুলো ফুলে ওঠে, আর ঘরবাড়িতে টিনের ছাদের শব্দে ঘুম ভাঙে। অনেক সময় পাহাড় ধসে ঘরবাড়ি ভেসে যায়,কেউ হারায় জীবনের সবকিছু। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, পরদিনই সেই মানুষগুলো আবার ঘর গড়ে, আবার জীবন শুরু করে। যেন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করাটাই তাদের জন্মগত অভ্যাস।
পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে হঠাৎই। সূর্য ঢলে পড়লে পুরো গ্রাম অন্ধকারে ডুবে যায়। কেরোসিনের বাতি বা সৌর বাতির ক্ষীণ আলোয় ঘরগুলো আলোকিত হয়। বাতাসে তখন একটা মিশ্র গন্ধ আদা, মরিচ, কাঠের ধোঁয়া, আর বৃষ্টির মাটি। শিশুরা পড়ার বই খুলে বসে, নারীরা আগুনে ভাত রান্না করে, পুরুষরা দিনের ক্লান্তি মুছে নেয় এক কাপ চায়ে। চারদিকে নীরবতা, শুধু পাহাড়ি নদীর গুঞ্জন শোনা যায় দূরে।
এই জীবনযাত্রা যতটাই কষ্টের হোক, তাতে আছে এক অদ্ভুত শান্তি। শহরের মানুষ হয়তো একদিনও এমন পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে না, কিন্তু পাহাড়ের মানুষ এই কঠিন বাস্তবতাকেই আপন করেছে। তারা জানে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই না করে তাকে মেনে নিয়েই টিকে থাকতে হয়। তাদের জীবনে নেই বড় কোনো স্বপ্ন বা বিলাসিতা, আছে কেবল নিশ্চিন্তে একবেলা খেতে পারার তৃপ্তি।
অর্থনৈতিকভাবে পাহাড় এখনো পিছিয়ে। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কিছু ছোঁয়া এলেও ভেতরের এলাকায় পৌঁছাতে পারেনি। অনেক গ্রামে এখনো রাস্তা হয়নি, স্কুলে শিক্ষক নেই, হাসপাতালে ডাক্তার নেই। কিন্তু আশার আলো এখনো জ্বলছে মানুষের চোখে। নতুন প্রজন্ম শিক্ষা পাচ্ছে, কেউ কেউ শহরে গিয়ে পড়াশোনা করছে, আবার ফিরে এসে নিজ গ্রামে কিছু করার চেষ্টা করছে।
পাহাড়ের মানুষের জীবনে ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবই গভীরভাবে মিশে আছে। উৎসবের সময় তারা একসঙ্গে গান গায়, নাচে, পিঠা বানায়, পরস্পরের ঘরে যায়। প্রতিবেশী মানেই আত্মীয়ের মতো। কোনো ঘরে খাবার রান্না হলে গন্ধে প্রতিবেশী চলে আসে, একসঙ্গে খায়। এখানেই হয়তো পাহাড়ের জীবনের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য সহাবস্থান ও ভালোবাসা।
নারীরা এখানে কেবল সংসারের অংশ নয়, তারা উৎপাদনেরও অংশ। কেউ হস্তশিল্প তৈরি করে, কেউ কাপড় বোনে, কেউ বাঁশ-বেতের ঝুড়ি বানায়। এসব পণ্য এখন ধীরে ধীরে পর্যটন এলাকাগুলোতে বিক্রি হচ্ছে, ফলে নারীরা পাচ্ছে আর্থিক স্বাধীনতা। কিন্তু এখনো সমাজে তাদের ভূমিকা পুরোপুরি স্বীকৃতি পায়নি। তবুও তারা নির্ভরযোগ্যভাবে টিকে আছে।
পাহাড়ের জীবনে প্রযুক্তি এখন ঢুকছে ধীরে ধীরে। কিছু জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক এসেছে, কিছু পরিবারে আছে ছোট সৌর প্যানেল। কিন্তু ইন্টারনেট এখনো স্বপ্ন। শিশুরা এখনো জানে না “অনলাইন ক্লাস” বলতে কী বোঝায়। শহরের শিশু যখন ট্যাব নিয়ে বসে থাকে, তখন পাহাড়ের শিশু বই না থাকলে পাথরে লিখে অঙ্ক শেখে।
বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ের মানুষ উন্নয়ন, সুযোগ আর ন্যায্যতার প্রতীক্ষায় আছে। অনেক প্রকল্পের কাজ হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা কতদূর মানুষের ঘরে পৌঁছে সে প্রশ্ন এখনো থেকে গেছে। রাস্তা বানানো হয়, কিন্তু বর্ষায় তা ভেঙে পড়ে; স্কুল হয়, কিন্তু শিক্ষক থাকে না; হাসপাতাল হয়, কিন্তু ডাক্তার আসে না।
তবুও পাহাড়ের মানুষ হতাশ নয়। তাদের মুখে সবসময় একটা শান্ত হাসি। তারা বিশ্বাস করে একদিন সব বদলাবে। হয়তো সেই দিনটা এখনো অনেক দূর, কিন্তু পাহাড়ের আকাশে সেই আশার আলো আজও ঝলমল করে।
রাতে যখন চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়, পাহাড়ের চূড়ায় তখন তারা ঝিলমিল করে। দূর থেকে মনে হয়, সেই তারা যেন পাহাড়ের মানুষগুলোর চোখে জ্বলা আশা। নিঃশব্দ এই জীবনযাত্রার প্রতিটি দিনে আছে গল্প, আছে বেঁচে থাকার এক অনন্য দর্শন যা শহরের কোলাহল বুঝতে পারে না।
পাহাড়ের জীবনযাত্রা এমনই নীরব, কিন্তু গভীর। কঠিন, কিন্তু শান্ত। সংগ্রামময়, কিন্তু মর্যাদায় ভরা। এই মানুষগুলো আমাদের শেখায়, বেঁচে থাকা মানে কেবল শ্বাস নেওয়া নয়; মানে হলো প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করে, প্রতিদিন নতুন করে শুরু করা। তাদের পাহাড়ের বুকের মতো দৃঢ় মন, আর তাদের হাসির মতো নির্মল হৃদয়ই হয়তো এখনো ধরে রেখেছে এই দেশের সৌন্দর্য।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
