× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

মাচাংঘর বিলুপ্তির পথে, হারাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্য

উচ্চপ্রু মারমা, রাজস্থলী (রাঙ্গামাটি)

১২ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৪৬ এএম

রাঙামাটির রাজস্থলী পার্বত্যাঞ্চলে একসময় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে চোখে পড়ত সারি সারি উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশ ও কাঠের তৈরি মাচাংঘর। প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে থাকা এসব ঘর ছিল শুধু বাসস্থান নয়, বরং পাহাড়ি সমাজের জীবনধারা, ঐতিহ্য ও সুরক্ষার প্রতীক। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন, আধুনিকতার স্পর্শ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক রূপান্তরের ঢেউয়ে এখন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী মাচাংঘর।

ঐতিহ্যের প্রতীক মাচাংঘর

শত শত বছর ধরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নিজেদের জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তৈরি করেছে মাচাংঘরের ধরণ। বাঁশ, কাঠ ও তক্তা দিয়ে গড়া এই ঘরগুলো পাহাড়ি ঢালের ওপর পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকত। বন্য প্রাণীর আক্রমণ, বর্ষার পানি ও কাদা থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি মাচাংঘর ছিল প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহের সুবিধাজনক আবাস। গরমে ঠান্ডা ও শীতে উষ্ণ রাখার উপযোগী এই ঘরগুলো প্রকৃতির সঙ্গে পাহাড়ি মানুষের সহাবস্থানের প্রতীক ছিল।

রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের প্রবীণ বাসিন্দা সাংউমে মারমা বলেন- “আমাদের ছোটবেলায় পুরো পাড়াজুড়ে মাচাংঘরের সারি দেখা যেত। এখন এক-দুটি ছাড়া আর কিছুই নেই। সবাই এখন পাকা ঘর বানাচ্ছে, যদিও মাচাংঘর ছিল অনেক বেশি ঠান্ডা, বাতাস চলাচলের সুবিধাজনক ও পরিবেশবান্ধব।''

আধুনিকতার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য

শিক্ষার প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রভাবে পাহাড়ি সমাজেও আধুনিক স্থাপত্যের ছোঁয়া লেগেছে। এখন অনেকেই পাকা ইট-সিমেন্টের ঘর নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

নতুন প্রজন্মের কাছে মাচাংঘর হয়তো অচল একটি ঐতিহ্য- কিন্তু পুরনো প্রজন্মের কাছে এটি স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রাজস্থলী উপজেলা তরুণ সমাজকর্মী উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন - “মাচাংঘর কেবল কাঠের ঘর নয়, এটি ছিল আমাদের সংস্কৃতির হৃদস্পন্দন। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে জুমের ধান ভাগাভাগি -সব কিছুই ঘটত মাচাংঘরে। এখন সেগুলো হারিয়ে গেলে আমাদের সংস্কৃতির একটা অধ্যায়ও হারাবে।”

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগের প্রয়োজন

রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আদোমং মারমা বলেন - “আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে মাচাংঘরের জীবনধারা তৈরি করেছিলেন। আধুনিকতার নামে সেই ঐতিহ্য হারানো কষ্টদায়ক। আমরা চাই, সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন মিলে কিছু মাচাংঘর সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করুক। এতে আমাদের সংস্কৃতি বাঁচবে, আর পাহাড়ে পর্যটনও বাড়বে।”

তিনি আরও বলেন-“আজ যদি আমরা এই ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগ না নেই, তাহলে আগামী প্রজন্ম কেবল বইয়ের পাতায় বা ছবিতে মাচাংঘর দেখতে পাবে। তাই পাহাড়ি সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এখন সময়ের দাবি।”

হারিয়ে যাচ্ছে নান্দনিক পাহাড়ি সৌন্দর্য

একসময় পাহাড়ি গ্রামগুলোর ভোরবেলা বা গোধূলির আলোয় মাচাংঘরের সারি যেন একেকটি জীবন্ত চিত্রকর্মের মতো লাগত। ঘরের নিচে শুকাতে দেওয়া ধান, পাশে জুমের ঝুড়ি, শিশুদের হাসি -সব মিলিয়ে ছিল এক অপরূপ দৃশ্য। কিন্তু আজ সেই দৃশ্য প্রায় বিলীন। এখন পাহাড়ে জায়গা নিচ্ছে আধুনিক কংক্রিটের ঘর, হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সুরেলা বন্ধন।

স্থানীয়দের দাবি: ঐতিহ্য রক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ

স্থানীয়রা মনে করেন, মাচাংঘর শুধু বাসস্থান নয়-এটি পাহাড়ি জাতিসত্তার পরিচয় ও ঐতিহ্যের বাহক। সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগে যদি কিছু মাচাংঘর সংরক্ষণ করে “ঐতিহ্য গ্রাম” বা “সংস্কৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে এই ঐতিহ্য অন্তত আংশিকভাবে হলেও টিকে থাকবে।

উল্লেখ্য,পাহাড়ের মাচাংঘর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এখনই যদি সংরক্ষণে উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে অচিরেই এই মাচাংঘর শুধুই বইয়ের পাতা আর স্মৃতিচারণায় সীমাবদ্ধ থাকবে।


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.