× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

পানি সংকটে বদলে গেছে জীবন-জীবিকা

তানোর(রাজশাহী)প্রতিনিধি

১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:০৩ পিএম

রাজশাহীর তানোরসহ প্রচন্ড খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা প্রবণতা বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতে। ফলে খরা, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব থেকে বেশী ক্ষতির মুখে পড়ছে কৃষক সমাজ।

জানা গেছে, বিগত ২০০৯ সাল থেকে গত কয়েক দশকে জলবায়ুর আমূল পরিবর্তনের প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে বদলে গেছে এ অঞ্চলের জীবন ও জীবিকা। পরিবেশবিদ ও গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি।গড়ে ৪০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়। গত ১০ বছরে বৃষ্টির পরিমাণ একেবারেই কম। বছরের প্রায় আট মাসই থাকে বৃষ্টিহীন। এ অঞ্চলে শক্ত এঁটেল মাটির কারণে ভূগর্ভে পানি নামে না। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৮ মিটার উঁচু। ভারতের পানি বৈষম্যের কারণে নদীগুলোতে নাব্যতা নেই। এসব কারণে ২০০০ সালের পর থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপক হারে নেমেছে। যার প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন ও জীবিকায়।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তথ্যমতে, বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলা নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলে রয়েছে বিস্তীর্ণ তিন ফসলি জমি, যাতে ধান-গমের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশের সিংহভাগ চালের জোগানদাতাও এ অঞ্চল। ধান বোনা থেকে শুরু করে কর্তনের আগ পর্যন্ত প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, যা অন্য কোনো ফসলে লাগে না। প্রাকৃতিকভাবে পানির জোগান না থাকায় এসব ধানি জমিতে পানির জোগান দেয় বিএমডিএ। এ অঞ্চলজুড়ে বিএমডিএর রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ডিপ টিউবওয়েল, যা ভূগর্ভের পানি তুলে জমিতে দেয় চাষাবাদের জন্য। তীব্র পানি সংকটের কারণে ২০০৯ সাল থেকে বরেন্দ্রভূমিতে খরাপ্রবণতা বেড়েছে। গত ১০ বছর এ অঞ্চলে বৃষ্টিও হচ্ছে অনিয়মিত ও স্বল্প। এদিকে দিনের পর দিন সারা বছর চাষাবাদের জমিতে পানি সরবরাহের কারণে ভূগর্ভের পানি উল্লেখযোগ্য হারে নামছে। 

সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাটের ৫০টির মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে ছোট-বড় কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। এ বিষয়ে কথা হয় ব্র্যাকের সিনিয়র ম্যানেজার মিথুন মজিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে পানির। আগে এ এলাকায় ধান চাষ হতো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ সেই ধানি জমিতে শ্রমিক হিসেবে খাটত, কেউবা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করত। দিনে দিনে পানি সমস্যা তীব্র হওয়ায় এখন মানুষ ধান-গমের বিকল্প হিসেবে আম চাষের দিকে ঝুঁকেছে। এ কারণে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের একটা বড়সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে আমরা কৃষি, মৎস্য, পশুপালন ও ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পের ট্রেনিং, লোন ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে তাদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কাজ করছি। এখন তারা বৃষ্টির পানি নিজের বাড়ি ও আশপাশের ডোবা-নালায় প্লাস্টিকের পলি ব্যবহার করে জমিয়ে সবজি চাষের জন্য দীর্ঘদিন ব্যবহার করছে। গ্রামীণ এলাকায় পুকুরে পলিথিন ব্যবহার করে তারা বৃষ্টির পানি জমিয়ে সেই পানি চাষাবাদসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে পারছে। বর্তমানে তারা মাছ চাষ, পশুপালন, সবজি চাষ, জৈব সার তৈরিসহ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে।

নওগাঁর সাপাহার উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর নারী সুশীলা যোসেফ। ব্র্যাক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের বাড়ির আশপাশে করছেন চাষাবাদ। পালছেন হাঁস, মুরগি, গরু ও ছাগল। এ নারী বলেন, ‘আমার বাড়ির আশপাশে অনেক জঙ্গল আর পতিত জমি ছিল। ব্র্যাক থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে এসব জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে গাছপালা, শাক-সবজির আবাদ করি। পানির অভাব দূর করতে বর্ষার পানি কাজে লাগানোর জন্য পলিথিন ব্যবহার করে নালা তৈরি করি এবং সেটি ব্যবহার করছি। এখন আমি ও আমার পরিবার বেশ ভালো আছি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আব্দুর রহিম মহানন্দা নদীর মাঝি ও জেলে ছিলেন। তবে নদীতে পানি সংকট হওয়ায় মাছও নেই, নৌকায় চড়ার মানুষও নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে রাজশাহীতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘নদীই ছিল আমার জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস। কিন্তু গত বছর দশেক ১২ মাসের মধ্যে আট মাসই পানি থাকে না নদীতে। কয়েক বছর যাবত একেবারেই পানি নেই। নদীতে মাছ ধরে, নৌকা চালিয়ে আর চরে কিছু আবাদ করে ভালোই চলত। কিন্তু বাধ্য হয়ে ওই পেশা ছেড়ে রাজশাহী এসে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছি।’ 

একই এলাকার বাসিন্দা সুকান্ত হেমব্রন বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগে এ অঞ্চলে ধান ছাড়া কিছুই চাষ হতো না। কিন্তু পরে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে সবাই আমবাগান করে। এজন্য আমাদের কাজ কমে যায়। তবে বছর খানেক হলো ব্র্যাক আমাদের এলাকায় এসে উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি শেখানোর কারণে আমরা এখন বন-জঙ্গল ও খেত-খামারে শাক-সবজির আবাদ করে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতে সক্ষম হচ্ছি।’

রাজশাহীর তানোর উপজেলার চিনাশো গ্রামের আমপুকুরিয়া এলাকার সিমলি কুণ্ডু নামের এক নারী বলেন, ‘তীব্র পানি সংকটের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে। কাজ-কর্ম না থাকায় শহরে গিয়ে লেবারি (শ্রম বিক্রি) করছে। আমাদের আমপুকুরিয়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষই শহরে লেবারি করে। কেউ রিকশা চালায়, কেউ হোটেলে কাজ করে আবার কেউ রাস্তা অথবা বিল্ডিং নির্মাণের কাজ করে। গ্রামের পানির সংকট থাকায় কৃষিকাজ খুব কমে গেছে।’

এদিকে ওয়াটার রিসোর্সেস প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) ‘জুলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড মডেলিং অব দা সারফেস অ্যান্ড গ্রাউন্ড ওয়াটার রিসোর্সেস ইন দা হাই বারিন্দ রিজিওন’ নামক ২০২৩ সালের এক গবেষণা রিপোর্টেও এমন তথ্য পাওয়া যায়। এ গবেষণাটি করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান। এটি এখনো চলমান রয়েছে।



Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.