শীতকাল মানেই এক বিশেষ স্বাদের খাবার মোয়া। খেজুরের গুড়, চিঁড়া বা মুড়ি, নারকেল আর ঘরে তৈরি উনুনের উষ্ণতায় প্রস্তুতকৃত এই মিষ্টান্ন ছিল বাঙালির ঘরোয়া সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দ্রুত বদলে গেছে জীবনযাত্রা, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শীতের এই ঐতিহ্যও।
গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে যেখানে একসময় শীতের শুরুতেই মোয়া তৈরির ধুম লেগে যেত, সেখানে এখন তা প্রায় অনুপস্থিত। বাজারকেন্দ্রিক জীবন, ব্যস্ততা, খেজুর গুড়ের সংকট, আর তৈরি খাবারের প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আগে মোয়া ছিল শীতের উৎসব, পারিবারিক মিলন আর গ্রামের নারীদের হাতের শিল্প। এখন সেটি শুধু স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, “শীত এলেও আর আগের মতো মোয়ার ঘ্রাণ পাওয়া যায় না।”
সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত আধুনিকতার যুগে ঐতিহ্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এই গতিতে চললে শীতের মোয়া কেবল বইয়ের পাতায় বা স্মৃতির গল্পে আটকে থাকবে - বাস্তব জীবনে নয়।
শীতের সকালে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, নতুন ধান ওঠার সময় মুড়ি ও গুড় দিয়ে মোয়া তৈরির চল ছিল। এটি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাস্তার একটি অংশ, যা সকাল ও বিকেলের নাস্তায় পরিবেশন করা হয় এবং অতিথি আপ্যায়নেও এর জুড়ি নেই।
হাতে বানানো মোয়ার কিছু তথ্য:
ঐতিহ্যবাহী খাবার: মোয়া শুধু একটি খাবার নয়, এটি বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ, বিশেষ করে শীতকালে এর চাহিদা বাড়ে।
উপকরণ: সাধারণত মুড়ি, গুড় (তরল বা পাটালির), এবং ক্ষেত্রবিশেষে কনকচূড় ধানের খই, খেজুর গুড় ও ঘি দিয়ে তৈরি হয়।
প্রস্তুত প্রণালী: মুড়ি বা খই গুড়ের সাথে মিশিয়ে গোলাকার মণ্ড তৈরি করে মোয়া (মোল্লা)বানানো হয়। এটি একটি সহজ ও সুস্বাদু খাবার।
এর জনপ্রিয়তা: শহরে প্রচলন কম হলেও, গ্রামে এখনো এটি একটি জনপ্রিয় খাবার। এছাড়া, শীতের সময় ছাড়াও ঠান্ডা আবহাওয়ায় এটি তৈরি করা হয়।
শহর অঞ্চলে যান্ত্রিক জীবনে হাতে বানানো মোয়ার চল কমে এলেও, এর চাহিদা এখনো রয়েছে। এটি সকালের নাস্তায় বা বিকালের চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করা যায়।
লক্ষীপুর রামগঞ্জের মোয়া শীত মৌসুমের নাস্তা, যা তৈরি হয় পানপাড়া ও ইছাপুরে । এর খ্যাতিও রয়েছে প্রচুর। এটি কনকচূড় বিয়ার, ২৮ বিয়ার ২৯ধানের খই, খেজুর গুড় ও গাওয়া ঘি দিয়ে তৈরি হয়।
সুতরাং, শীতের সকালে হাতে বানানো মোয়া হলো বাঙালির একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রিয় খাবার যা এই সময় বিশেষ গুরুত্ব পায়।
মোয়া তরল খেজুর গুড় আবার পাটালি মিঠাই তরল করে চুলার উপর বসিয়ে গরম করে গরম তরল মিঠাইর উপরে মুড়ি অথবা চিড়া ভালোভাবে মিশিয়ে হাতের ইশারায় গোলাকার করে তৈরি হয়। এরপর ঠান্ডা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মুড়ি অথবা চিড়ার মিশানো গোল্লাগুলো শক্ত হয়ে মোয়া তৈরি করা হয়।
মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া এসব শুধুমাত্র খাবার নয় বাঙালির ঐতিহ্যেরও অংশ। শীতের দিনে পিঠাপুলির পাশাপাশি এই মুড়ির মোয়া তো থাকবেই সকাল বিকালের নাস্তায়। মুড়কি-মোয়া বাঙালির ঐতিহ্য বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শীতের সময়ে কৃষকের বাড়িতে নতুন ধান ওঠে। এই সময়ে মুড়ি ভাজা ও মুড়ির মোয়া বানানোর ধুম পড়ে।
শীতের সকালে নাস্তার টেবিলে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি মুড়ির মোয়া সব শ্রেণির মানুষের কাছে একটি অন্যতম আর্কষণ। শীত আসলেই নতুন ধান থেকে মুড়ি তৈরি করে আর সেই মুড়ি থেকে গুড় দিয়ে মোয়াসহ বিভিন্ন নাস্তা তৈরি করা হয়। তবে এটি এখন আর শুধু ঘরে তৈরিতে সীমাবদ্ধ নেই বাণিজ্যিকভাবে লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে এটি তৈরি হচ্ছে। এই মোয়া বিক্রি করে লাভবান হবার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। লক্ষ্মীপুরে শীত বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে শীতকালীন নানা ধরনের খাবার। আখ এবং খেজুর গুড় জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে সেখানে সাদা ধবধবে মুড়ি মাখিয়ে তৈরি করা হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ির মোয়া। এটি গ্রাম-শহরের নানা বয়সী মানুষের শীতের দিনের মুখরোচক খাবার। আরও এই মুখরোচক খাবারটি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করছেন জেলার সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ লতিবপুর ইউনিয়নে ও লক্ষীপুর রামগতি চর আলেকজান্ডার মেঘনা নদীর পাড়ে।
চর রমিজ গ্রামের বাসিন্দা সোলেমান বলেন , শাপলা বেগম দম্পতি তারা বাড়িতেই বাণিজ্যিকভাবে হাতে তৈরি করছেন মোয়া। তাদের তৈরি সুস্বাদু এই মোয়া স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বিভিন্ন উপজলোর হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি একশ’ পিস মোয়া বিক্রি হয়ে চারশত থেকে পাঁচশত’ টাকায়। মেকারের পেশায় থাকাকালীন সোলেমান অসুস্থ হয়ে পড়ে এরপর তেমন ভারী কাজ করতে না পারায় ২০২১ সালে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে শুরু করেন মোয়ার ব্যবসা। এরপর দিন যতই যাচ্ছে তার মোয়ার পরিচিত ততই বাড়ছে।
রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের মঙ্গল হাওলাদার বলেন, আমি ১৯৯২ সাল থেকে মোয়া তৈরি করে আসছি। আমার দেখাদেখি আমাদের গ্রামে বর্তমানে বিভিন্ন বয়সী ২৮-৩০ জন নারী-পুরুষ এই মোয়া তৈরি করে।
শীত মৌসুমে মোয়া তৈরি করে গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আবার দেখা গেছে কিছু নিরীহ শ্রমিকরা নিজেদের সংসারের কাজ করে এসে দিন দুইশ’তিনশত টাকা মজুরিতে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে মোয়া তৈরির কাজ করতো। প্রতিদিন গড়ে ৫ -৬ মণ মুড়ি দিয়ে মোয়া তৈরি হয় ১৫ হতে ২০ হাজার পিস। স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভেজাল মুক্ত এসব মোয়ার বেশ চাহিদা দেখা যেতো আমাদের এই রায়পুর- লক্ষ্মীপুরে। পার্বতী নগর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, শীতকালে ফজরের নামাজের পর প্রচন্ড শীতে আমি এবং আমার পরিবারে সবাই চুলার পাশে বসে আগুনের তাপ নিয়ে শীত নিবারণ করতাম।
এরই মাঝে কানে ভেসে আসতো লইবেন নি গো মোয়া রাখবেননি গো মোয়া আর তখনই বাড়ির বুড়ো থেকে শুরু করে বাচ্চারা পর্যন্ত মোয়া কিনার জন্য মোয়া ওয়ালা কে ডাকতো। কেউ কেউ নগদ টাকা, আবার কেউ চাউল,কেউ নারিকেল, কেউবা কাঁচা -পাকা সুপারি নিয়ে হাজির হতো কার আগে কে মোয়া নিবে, তা নিয়ে ঝামেলা শুরু করে দিত।
সোনাপুর গ্রামের কাছারিবাড়ি তারেক জানালেন, শীত মৌসুমে যখন কুয়াশা ভরা সকাল বেলায় গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে মাথায় মোয়া অথবা মোল্লার ঝুড়ি নিয়ে বেপারী হাক-ডাক দিত রাখবেন নি গো মোয়া ওরে রাখবেন নি গো মোয়া তখন ঘর থেকে ছুটে এসে বেপারীকে বলতাম মোয়া নিব এক গোল্লা কত।
বেপারী উত্তরে বলতেন সুপারি এক গন্ডা মানে চারটা দিয়ে এক গোল্লা মোয়া আর তখনই নিজেদের গাছে সুপারি রেখে চাচা জ্যাঠাদের সুপারি গাছের দিকে নজর যেতো। তারেক আক্ষেপ করে বলেন, এখন আর ঠিক মৌসুমে গ্রামে মোয়ার বেপারীর হাক ডাক শোনা যাচ্ছে না। বাঙালির শীতের স্বাদবাহক মোয়া - সময়ের চাপে হারাতে বসা এক ঐতিহ্য।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
